1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ০৫:৪৬ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

অটিজম রোধে বাংলাদেশ : মুহম্মদ সবুর

  • আপডেট সময় রবিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

‘দুর্বল বুদ্ধিকে স্নেহের অধিকার হইতে বঞ্চিত করিও না’ বলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন আজ থেকে ৭৮ বছর আগে। বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে দুর্ভাগা সেই, যার বোধের বিকাশ অসম্পূর্ণ। অথচ সেই কারণেই সংসারের দয়া না পেয়ে সে পদে পদে শাস্তিই পেয়ে থাকে। সাধারণত বুদ্ধির অভাবকৃত ত্রুটিকে অধিকাংশ লোকে ইচ্ছাকৃত অপরাধ বলেই গণ্য করে থাকে।’ রবীন্দ্রনাথ তার সমকালেই দেখেছিলেন জড়বুদ্ধি বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজ, সংসার ও মানুষের চরমতম অবহেলা, উপেক্ষা ও অনাদর। তাকে মানুষের মর্যাদা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জড় জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া শুধু নয়, মৃত্যুর দিকে ধাবিত করার প্রয়াসগুলো রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাদের প্রতি স্নেহ-মমতা বর্ষণের জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, ‘কাজের ক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে ও সমাজে সর্বত্রই এই অবিচারজনিত নিষ্ঠুরতা আমরা সর্বদাই দেখতে পাই। দুর্বল বুদ্ধিকে প্রবল শাসন দ্বারাই সংশোধন করা যায়, এ নির্দয় বিশ্বাস মানুষের আদিম বর্বরতার অনুবৃত্তিরূপে আজও চলে আসছে।’
বাংলাদেশে ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষকে প্রতিবন্ধী হিসেবে ধরা হয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধী এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। সমাজের জন্য যা উদ্বেগজনক, তা পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্যও। কারণ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধীদেরও অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানসিক ও শারীরিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে দেখতে চান। সে কারণে আইন প্রণয়নসহ নানা উদ্যোগও রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন ধারার মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তথা অটিস্টিক শিশুদের। অটিস্টিক শিশুরা আক্রান্ত হয় অটিজম রোগে। অটিজম হচ্ছে শিশুমনের এক অদ্ভুত রোগ। মানসিক তো বটেই। এখন পর্যন্ত অটিজম কেন হয় তার সঠিক কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
জন্ম পরবর্তীকালের কোন জটিলতা কিংবা শিশুর প্রতি অমনোযোগিতার ফলে এ রোগের সৃষ্টি, তা কিন্তু নয়। অটিজম কারও নিজের সৃষ্টিও নয়। সুতরাং শিশুর এ রোগে আক্রান্ত হওয়া অপরাধ নয়। বাংলাদেশে সঠিক পরিসংখ্যান না হলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গড়ে প্রতি হাজারে ১০ থেকে ২০টি শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয়। তুলনায় উন্নত বিশ্বে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
চিকিৎসাশাস্ত্রে অটিজমকে আচরণগত সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। বলা হয়, মস্তিষ্কের কিছু ‘ডেভেলপমেন্টাল’ ত্রুটি, কিছু সমষ্টিগত সমস্যার সম্মিলিত প্রকাশ হচ্ছে অটিজম। ১৯৪৩ সালে মার্কিন চিকিৎসক লিও ক্যানার শিশুদের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ১১টি শিশুর মধ্যে আচরণগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করেন এবং এসব অস্বাভাবিক শিশুদের অটিজম রোগী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সাধারণত শিশুর বয়স ১৮ মাস থেকে তিন বছরের মধ্যে এ রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। যত দ্রুত রোগটি শনাক্ত করা যায়, শিশুদের জন্য ততই মঙ্গল। লিও ক্যানারের মতে, অনেক শিশু অটিস্টিক হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আবার অনেকে জের পরে নানা কারণে অটিজমে আক্রান্ত হয়। বিশ্বজুড়ে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অটিজম একটি অন্যতম সমস্যা। এবং তা অত্যন্ত গুরুতর, চিহ্নিত করা না গেলে।
মস্তিষ্কের বিকাশের সমস্যার কারণে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জড়বুদ্ধিতা, তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাদের ভাষার বিকাশ ঘটতে বেশ দেরিই হয়। সমবয়সী অথবা অন্যদের সঙ্গে সামাজিক স¤পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। ডাকলেও সাড়া দেয় না। আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। যাকে বলা যায়, ভাবুক। একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি করা এবং একই কাজ বারবার করতে নিমগ্ন থাকে। সরাসরি কারও চোখের দিকে না তাকানো, আদর করলেও সাড়া না দেয়াই অটিজমের লক্ষণ। কখনও মনে হয় কানে শোনে না, মাকে বা অন্য কোন প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে না বা তাদের কেউ স্পর্শ করলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না কিংবা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
অটিস্টিক শিশু-কিশোররা পঞ্চেন্দ্রিয়, যেমন- দেখা, শোনা, স্পর্শ, স্বাদ ও গন্ধে কোন না কোনভাবে সংবেদনশীল থাকে। এমনকি এই সংবেদনশীলতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে। স্বাদে গন্ধে কোন অভিব্যক্তি কখনও প্রকাশ পায় না।
অটিজম সারিয়ে তোলার জন্য কোন ধরনের কার্যকর চিকিৎসা গত ছয় দশকেও আবিষ্কার হয়নি। কানাডাসহ উন্নত দেশগুলোতে এ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা চলছে। তবে বাংলাদেশে চিকিৎসার ধরণটা ভিন্ন। চিকিৎসা বলতে গ্রাম এমনকি শহরেও ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ, পানিপড়া- ফলাফল শূন্য। অলৌকিক পন্থায় এ রোগের চিকিৎসা দুরূহতর। এদেশে মেয়েশিশুর চেয়ে ছেলেশিশুদের তিনগুণ বেশি এ রোগ দেখা দেয়। যখনই শিশুটি ঠিকমতো বাড়ছে না বা কথা বলছে না কিংবা অস্বাভাবিক আচরণ করছে- তখন এদেশে তার প্রতি নেমে আসে পারিবারিক ও সামাজিক নিপীড়ন। অনেক শিশুকে শেকল দিয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখার ঘটনাও ঘটে। অটিজম আক্রান্ত অনেক শিশু শুধু গ্রামে নয়, শহরেও অসহনীয় জীবনযাপন করছে। এসব শিশু বড় হচ্ছে অবহেলায়, অনাদরে, বঞ্চনায়।
‘এই সব মূঢ় ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা’র কবি রবীন্দ্রনাথ সাত দশক আগেও জড়বুদ্ধি শিশুদের অসহনীয়তার কথা ভেবেছেন। তারই অনুপ্রেরণায় ১৯৩৩ সালে মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে ‘দুর্বল মস্তিষ্ক শিশুদের আশ্রম’ স্থাপন করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের নামকরণ করেছিলেন ‘বোধনা নিকেতন’।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা লেখাপড়া, খেলাধুলা ও অন্যান্য কাজকর্মে নিজেদের নিবদ্ধ রেখে অন্য শিশুদের মতোই স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। আশ্রমে এসব শিশু মানসিক বিকাশে সহায়তা পেয়ে বোধ ফিরে পেতে পারে- এমন আশাও ছিল রবীন্দ্রনাথের।
রবীন্দ্রনাথের চাওয়ার পথ ধরে বাংলাদেশ যেন পথ চলছে। একাত্তরের যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জাতীয় অন্ধকল্যাণ সংস্থা, বধির সংস্থাসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সে সময় থেকেই গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের কারণে পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া বাঙালির বিদেশে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। অন্যান্য প্রতিবন্ধীকে সহজে শনাক্ত করা গেলেও অটিস্টিক শিশুকে শুরুতে শনাক্ত করা সহজ সাধ্য নয়, সচেতনতার অভাবে পরিবারগুলো তা নির্ধারণ করতে পারে না।
চিকিৎসকরাও এক্ষেত্রে খুব সচেতন, তা ভাবার কারণ নেই বলেই কোন নির্দেশনা না পাওয়া অভিভাবক শিশুটিকে যথাযথ প্রতিপালন করতে পারে না। বাংলাদেশে এ রোগের বিস্তৃতির ব্যাপকতা প্রথম সামনে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তিনি বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন এদেশে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুরা পরিবারে নিগ্রহ হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরকালে দেখেছেন। সে সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অন্যান্য প্রতিবন্ধীর মতোই বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা যাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য উন্নত চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করা একান্ত আবশ্যক। তারই প্রতিফলন নিজকন্যা সায়মা ওয়াজেদের অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতার কাজে এগিয়ে আসা। তিনি অটিজম সংক্রান্ত বাংলাদেশ জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির প্রধান এবং মার্কিন এনজিও অটিজম স্পিকসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি এখন অটিজম বিশেষজ্ঞ। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে ২ এপ্রিল নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজন করা হয়েছিল ‘সলভিং দ্য অটিজম পাবলিক হেলথ পাজেল : রিজিওনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল কোলাবরেশন’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা।
সেখানে সায়মা ওয়াজেদ বলেছিলেন, বাংলাদেশে অটিজম আক্রান্তদের সমস্যা সমাধানে প্রথমেই ইস্যুটিকে প্রাধিকার দিতে হবে। শুধু তাই নয়, আমাদের সীমিত সম্পদ দিয়ে এর সমাধানে একটি সৃজনশীল উপায় বের করতে হবে। অটিজমের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করায় সরকারের পাশাপাশি মিডিয়ার গুরুত্ব যে অসীম সে বিষয়টিও স্পষ্ট করেছিলেন তিনি।
সায়মা ওয়াজেদের মতে, এ ধরনের কার্যক্রমে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সামাজিক প্রত্যাশা; আর্থিক উৎস এবং বিদ্যমান অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গৃহীত কর্মসূচি সফলে সবার যোগদান আবশ্যক। এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ স্থানীয় স্টেকহোল্ডার, জনগণ এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে একযোগে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অটিজম এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধী আক্রান্তদের স্বনির্ভর ও উৎপাদনক্ষম মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com