আরব দেশের মক্কা নগরীর কোরাইশ বংশে এক আলোর দ্যুতি ঠিকরে পড়েছিল সেদিন। যে আলোকরশ্মি প্রত্যক্ষ করতে সমগ্র সৃষ্টি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষমাণ ছিল। সপ্তাকাশ, সাত জমিন, নক্ষত্ররাজি, আকাশ, পাতাল, বায়ু তথা নভোম-ল ও ভূম-লের সব মাখলুকাত সেই মহান অতিথির আগমনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিল। শুভ্র আকাশের মেঘপুঞ্জ নেচে নেচে যার প্রশংসাগাঁথা গাইছিল, বাতাসের হিল্লোল যার শুভাগমন আনন্দে পাতাগুলোকে দুলিয়ে নৃত্য প্রদর্শনে বাধ্য করছিল, মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের নাচন আনন্দের আতিশয্যে যার কদমবুচির আগ্রহে নিক্কনধ্বনি তুলছিল, বৃক্ষরাজি বিচিত্র পত্রপল্লবে সৃজিত পাখা নিয়ে যাকে বাতাস করে ধন্য হওয়ার স্বপ্নবিভোর ছিল- তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত উম্মতের কা-রি বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ স.। হাদিসে কুদসিতে খোদ আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, আমি মোহাম্মদকে সৃষ্টি না করলে কুল কায়েনাতের কিছুই সৃষ্টি করতাম না। সুতরাং অতি সহজেই অনুমেয় যে, যাকে সৃষ্টি না করলে বিশ্ব জাহানের কিছুই অস্তিত্বে আসত না, যার বদৌলতে সমগ্র মাখলুকাত সৃষ্টি- তার আগমনে সেদিন সৃষ্টিজগত কতটা উল্লাসে মেতেছিল, হুর-পরি কতটা সাজে সেজেছিল।
৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার সুবহে সাদিকের নির্মল প্রকৃতিতে ধরাধামে আগমন করেন হযরত মোহাম্মদ সা.। তবে ঐতিহাসিকগণ তার আগমন তারিখ নিয়ে মতভেদের দোলাচলে দোল খেয়েছেন। অধিকাংশের মতে, তার জন্মতারিখ ৯ রবিউল আউয়াল। এছাড়া ৭, ৮, ১১, ১২ রবিউল আউয়াল স¤পর্কেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল হতেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন হয়ে আসছে। তবে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুদিবস- এতে সব ঐতিহাসিকই ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
মোহাম্মদ সা. বিশ্বনবী। পৃথিবী সৃষ্টির পর হতে মানুষকে হেদায়েতের পথে আনতে আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে প্রায় দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রাসুল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তন্মধ্যে মাত্র একশ চারজন রাসুলের ওপর আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়। এ একশ চারজন কিতাবপ্রাপ্ত নবী ছাড়াও দুই লক্ষাধিক নবী-রাসুলই মহানবী (সা.)-এর উম্মত হওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন। অন্যান্য নবী-রাসুল আগে পৃথিবীতে আগমন করলেও মহানবী (সা.) কে আকর্ষণ হিসেবে আল্লাহতায়ালা সর্বশেষ হিসেবে বিশ্বমাঝে প্রেরণ করেন। তাইতো তিনি শেষ নবী তিনি খাতামুন্নাবিয়্যিন।
মোহাম্মদ (সা.) এক আদর্শ মহামানব। এর স্বীকৃতিস্বরূপ আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুল মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে রয়েছে অনুপম আদর্শ। তিনি মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ। শিশু, যুবা, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে তিনি সবার জন্যই আদর্শ। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী- সবার জীবনেই তিনি আদর্শ।
মহানবী (সা.) তখন শৈশবের গণ্ডি পেরিয়ে সতের বছরের বালক। তিনি দেখলেন, আরব দেশে বংশানুক্রমে গোত্রবিভেদ চরম আকার ধারণ করে আছে। একে কেন্দ্র করে ক’দিন পরপরই মারামারি হানাহানি হয়। বালক মোহাম্মদের অন্তরাত্মায় ব্যাপারটি দারুণভাবে বেদনার শলাকাবিদ্ধ করল। তিনি ভাবলেন- যে করেই হোক মানবতাকে এ দুর্বিষহ জীবন হতে মুক্তি দিতেই হবে। কিন্তু প্রক্রিয়া কী? আরববাসীর অস্থিমজ্জায় বংশপর¤পরায় যে প্রতিশোধের দাবানল জ্বলে আছে, তা হতে অতো সহজেই কি তাদের মুক্তবিহঙ্গে নিয়ে আসা যাবে? তিনি নিজ বয়সী তেরজন বালককে তার ব্যথাটি বোঝাতে সক্ষম হলেন। তারা বালক মোহাম্মদকে এ ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রত্যয়দীপ্ত হলেন। তিনি মাত্র সতের বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করলেন সেবামূলক সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’। এ হিলফুল ফুজুলের পরশে এসে সে যুগের যুবসমাজ এক বেহেশতী পরিবেশ খুঁজে পেল। ক্রমেই গোত্রবিদ্বেষ ছাইচাপা পড়তে শুরু করল। যৌবনের তারণায় যুবসমাজ যেসব অপকর্মে লিপ্ত হয়, বালক মোহাম্মদের পাশে এসে তারা হয়ে উঠল সোনার মানুষ। উলঙ্গপনা, বখাটেপনা, মাদকাসক্তি যে বয়সি যুবকদের নিত্যদিনের কর্ম, তারা মোহাম্মদের মিশনে যোগ দিয়ে হয়ে উঠল এর প্রতিরোধ আন্দোলনের জানবাজ সৈনিক। তাইতো বালক মোহাম্মদ এক অতুলনীয় আদর্শ। আজকের সমাজ যদি বালক মোহাম্মদের এ নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা হতে শিক্ষা নিতো, তাহলে অবশ্যই আমরা এক সোনালী সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সক্ষম হতাম।
আমানতদারির ক্ষেত্রে মোহাম্মদ (সা.)-এর তুলনা দু®প্রাপ্য। সেই জাহেলি যুগের পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন মানুষগুলো পর্যন্ত মহানবী (সা.)-কে শ্রেষ্ঠ আমানতদার বলে বিশ্বাস করতো। তাইতো তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে ‘আল-আমিন’ বা ‘মহাবিশ্বাসী’ বলে উপাধি দিয়েছিল। অতএব, আমানতদারির ক্ষেত্রে মোহাম্মদ (সা.)-এর মতো দ্বিতীয় কাউকে বিশ্বইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল।
শ্রমিকের অধিকার স¤পর্কে মহানবী (সা.) অনুপম আদর্শ। ‘শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও’- বলে বিশ্বনবী সা. যেই চিরন্তন উক্তি উচ্চারণ করে গেছেন, তা কালের আবর্তে গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শ্রমের সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণেই আমাদের দেশে ক’দিন পর পর আন্দোলন-সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যেসব শ্রমিক জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, তাদের স্মরণ করতো আজ বিশ্বপরিম-লে আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার দিবস পালিত হয়ে থাকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে শ্রমিকদরদী মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রদত্ত উপর্যুক্ত উক্তি যদি আজকের মালিকসমাজ সঠিকভাবে গ্রহণ করে, তাহলে মানুষ সত্যিই এক অনুপম পরিবেশ খুঁজে পেত। একইভাবে মহানবী (সা.) নিজে উটের লাগাম ধরে পালাক্রমে শ্রমিককে উপরে বসিয়ে টেনে নেয়ার নজির গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়টি আছে কি?
নারীর অধিকার বাস্তবায়নে মহানবী (সা.)-এর অনুপম আদর্শ বিশ্বনন্দিত। যেই যুগে মেয়েসন্তান জন্মানোকে কৌলিন্যের চাবিকাঠি মনে করা হতো, মেয়েসন্তান জন্মালে তাকে জীবিত গর্তে প্রোথন করে হত্যা করা হতো। এহেন অমানবিক ও জঘন্য অপরাধ আরব সমাজকে বিশ্ব দরবারে আজও নিন্দিত ও ধিক্কার দিয়ে আসছে। বিশ্বনবী (সা.) জাহেলি যুগের সেই কলুষিত অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আরব জাতিকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছিলেন। হযরত দাহিয়া কালবী রাজি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কাছে তার জাহেলি যুগের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, আমার একটি কন্যা ছিল। সে আমাকে খুব ভালোবাসত। তাকে নাম ধরে ডাকলে সে দৌড়ে কাছে আসতো। একদিন আমি তাকে ডাকলাম। তাকে সাথে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পথে একটি কুয়া পেলাম। তার হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাকে কুয়ার মধ্যে ফেলে দিলাম। তার যে শেষ কথাটি আমার কানে ভেসে এসেছিল। তা হলো- হে আব্বা! হে আব্বা! একথা শুনে রাসুলুল্লাহ সা. কেঁদে ফেললেন। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন বললেন, ওহে! তুমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শোকার্ত করে দিয়েছো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা তাকে বাধা দিও না। যে বিষয়ে তার কঠিন অনুভূতি জেগেছে সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করতে দাও। তারপর তিনি বললেন, তোমার ঘটনাটি আবার বর্ণনা করো। সে ব্যক্তি আবার তা শুনালেন। ঘটনাটি আবার শুনে তিনি এত বেশি কাঁদতে থাকলেন যে, চোখের পানিতে তার দাড়ি মোবারক ভিজে গেল। এরপর তিনি বললেন, জাহেলি যুগে যা কিছু করা হয়েছে আল্লাহ তা মাফ করে দিয়েছেন। এখন নতুন করে জীবন শুরু করো (সুনানে দারামি)। এমন অসংখ্য নির্মম হত্যাযজ্ঞ আরব সমাজে ঘটেছিল। ইসলাম-পূর্ব যুগে কন্যা সন্তানদের প্রতি পুতুল পূজারী কাফির-মুশরিকদের আচরণ ছিল অত্যন্ত কুৎসিত ও জঘন্য।
দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সর্বত্রই রাসুল (সা.)-এর অনুপম আদর্শ রয়েছে। বর্তমান দুনিয়ার সর্বত্র মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করলে সত্যিকারের কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব।
প্রতিবছর রবিউল আউয়াল মাস এলেই আমাদের মাঝে মহানবী (সা.)-এর আলোচনা হিড়িক পড়ে। মাসটি শেষ হয়ে গেলেই যেনো আমরা যেই সেই হয়ে যাই। আমরা মনে করি, মহানবী (সা.) শুধু এক মাসের জন্যই আমাদের নবী নন, তিনি আমাদের জীবনের সার্বক্ষণিক নবী। অতএব, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার আদর্শ অনুসরণ করে চলতে হবে।