‘অদ্ভুত আঁধার’-এর প্রসঙ্গ আছে জীনানন্দের কবিতায়। আর পৃথিবীতে যখন এই অদ্ভুত ‘আঁধার’ আবির্ভূত হয় তখন সেখানে ‘অদ্ভুত ঘটনা’ ক্রমাগত ঘটতেই থাকে, আটকানো যায় না। যেমন রোহিঙ্গাসঙ্কট মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি হয়ে যায় কিংবা একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর মেয়ের পরীক্ষা কেন ভাল হলো না তার প্রতিবাদে অনশন করতে বসে যান জেলা প্রশাসকের কক্ষের দোরগোড়ায়। আমরা চমকিত হই, বিস্ময়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয় এবং সবকীছু জেনেবুঝে জগৎসংসার সম্পর্কে গভীর অর্থে নিতান্তই অনভিজ্ঞ কেউ কেউ বিজ্ঞের মতো মুচকি হাসেন।
বসেছিলাম আরেক মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের ল্যাপটপের সামনে। হরিদাস নামের একজনকে নিয়ে লেখার বানানসংস্কার করছিলাম দু’জনে মিলে। তখন বোধ করি ঘড়ির কাঁটা নটার দাগ ছুঁই ছুঁই করছে। সহসা সুফিয়ানের মুঠোফোনে রিং বাজলো। মুহূর্ত কয়েক ওপাশের কথা শুনে সুফিয়ান বলল, ‘বারইতো অইবো।’ পীর ছাব নাকি কী একটা হুজ্জতে জড়িয়ে পড়েছেন। জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসকের কক্ষের দোরগোড়ায় তিনি ‘লাইড়’ (নিতম্ব) পেতে বসে পড়েছেন। এ কী কথা। সূর্য পশ্চিমে উঠার মতোই আশ্চর্য ঘটনা বটে। এমনও কী কখনও হয়? শুধু বুঝলাম তিনি অনশন শুরু করেছেন এবং একটা কীছু সুরাহা না হওয়ার আগে তিনি ক্ষান্ত হবেন না। আমাদের পীর ছাব ছাড়া আর কেউ এমন অদ্ভুত কাণ্ড করতেই পারে না। এই পীর ছাব হলেন, আমাদের সুনামগঞ্জ শহরের আদি অকৃত্রিম বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর।
বিষয় কী? বিষয় গুরুতর।
কেচ্ছার শুরু এইভাবে। পীরজাদী পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরেছেন। পীরছাব কন্যার পরীক্ষার হালহকিকত ওয়াকিবহাল হতে চাইলেন। পীরজাদী জানালেন তার আজকের পরীক্ষা ভাল হয় নাই। আর যায় কোথায়? ছেঁকে ধরতেই না পারতে মেয়ে শেষমেষ পরীক্ষা খারাপের কারণ হিসেবে জানালেন, কলেজে আজকের পরীক্ষার বিষয়ে কোনও ক্লাসই নেওয়া হয়নি।
এমতাবস্থায় পীরের প্রশ্ন, পড়ানো হবে না তো পরীক্ষা নেওয়া হবে কেন? পরীক্ষা নেওয়া হলে পড়ানো হবে না কেন? আমি আমার মেয়েকে পড়ানোর জন্যে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছি, সে জন্য নিয়মমতো টাকা পরিশোধ করেছি এবং বেতনও বাকি রাখি নাই। পরীক্ষার ফিও দিয়েছি। তা হলে পাঠদান করা হলো না কেন?
কলেজের বাইরে কোনও একজনের কাছে নির্দিষ্ট বিষয়টি, যে বিষয়টি কলেজে পড়ানোর কথা ছিল কিন্তু পড়ানো হয়নি, পড়ানোর আর্থিক সঙ্গতি কারও থাক কিংবা না থাক, সেটা আলাদা কথা। কলেজে যে পাঠ পড়ানোর কথা সেটা কোনও ছাত্র কেন কলেজের বাইরে পড়তে বাধ্য হবে এবং সে পাঠ নেওয়ার খরচ হিসেবে কলেজের বেতনের বাইরে তাকে বাড়তি টাকা গচ্চা দিতে হবে? এই পদ্ধতিতে কি শিক্ষা খরচ দ্বিগুণ হয়ে পড়ে না? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি শিক্ষাকে এমনি করে দামি পণ্য করে তুলছে না? আমি আমার মেয়েটিকে কলেজে ভর্তি করে কি কোনও গর্হিত অপরাধ করেছি? আমার কী কসুর হয়েছে? পীরের এতসব প্রশ্নর উত্তর কে দেবে?
আমি তাকে একটি উত্তর দিতে পারি। জানি তার সেটা মনোমতো হবে না। এমনকি অনেকেই সে উত্তর শুনে তিতিবিরক্ত হতে পর্যন্ত পারেন। তবু বলি। মালেক পীর একদিন প্রাণবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। স্বাধীন দেশ নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। তাঁর স্বাধীন করা দেশে তাঁর সন্ততিরা নিখরচায় না হোক কম খরচে পড়াশোনা করবে। শিক্ষাকে দামি পণ্য করে তোলা হবে না। শিক্ষাকে বেসরকারি করে দেওয়া হবে না। কিন্তু তা তো হলো না। বাস্তবে সরকারি শিক্ষাকে বেসরকারি করে তোলা হয়েছে সুকৌশলে। আর সে কৌশলটি হলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে শিক্ষার বিষয়টিকে চালু রাখা হয়েছে এবং বেসরকারি উৎস থেকে পাওয়া যেতে পরে এমন একটি দামি পণ্য করে তোলা হয়েছে। এই কৌশলের আর একটি অভিমুখ হলো শিক্ষাকে পীরছাবের মতো হতদরিদ্রের সন্তানদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রাখা। আর শিক্ষাকে নি¤œবিত্ত শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রাখার এই কৌশলের আর একটি অধিঅভিমুখ হলো, সমাজে শিক্ষাসংকোচনের প্রতিক্রিয়াশীল পদ্ধতিকে বরাবরের মতো বহাল রাখা।
ঘোষণা দিয়ে, আইন করে অনুসৃত শিক্ষানীতি যাই হোক, তাতে কীছু যায় আসে না, সেটা কেতাবেই থেকে যায়। কার্যত শিক্ষা পদ্ধতি হয়ে পড়েছে নিম্নবিত্তের লোকজনকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার একটি শিক্ষানীতি। ভবিষ্যতে পীরছাবের সন্তানরা নিজেদের জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দেখবে তারা ভাল আয়রোজগারের কোনও উপায়ই অবলম্বন করতে পারছে না। শিক্ষাগত যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকার ফলে কাক্সিক্ষত চাকরিটি পাবেই না, গরিব গরিবই থেকে যাবে। কারণ যথাসময়ে শিক্ষাটা কেনার টাকা তার হাতে ছিল না, অর্থাভাবে মেয়েটিকে তিনি প্রাইভেট পড়াতে পারেনি। সুতরাং চাকরি পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতায় ধনীর সন্তানের চেয়ে তার সন্তানটি পিছিয়ে আছে।
সুতরাং বুঝাই যায় সঙ্গত কারণেই পীরছাব ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁর মেয়েকে কলেজে ভর্তি করে শিক্ষাদানের নাম করে বেতন নিয়ে কোন একটি বিষয়ে কেন পড়ানো হবে না? এই না পড়ানোর কারণে তাঁর মেয়েটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে, তার দায় কে নেবে? পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় শিক্ষাগত অযোগ্যতার কারণে মেয়েটি অংশ নিতে পারবে না, সে অযোগ্য বিবেচিত হবে। যোগ্য করে তোলার জন্য যে টাকা পীরছাব কলেজের বেতন হিসেবে খরচ করলেন, সে টাকাতো তোন কাজেই লাগল না, তার কী হবে? সে টাকাটা তাকে কে ফেরত দিবে? যে শিক্ষাপদ্ধতি মেয়েকে যোগ্য করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পীরছাবের পকেটের টাকা হিসেবে প্রতিমাসে আদায় করে নিয়েছে অথচ বছর শেষে প্রকৃতপ্রস্তাবে মেয়েটিকে করে তোলা হয়েছে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার মতো একজন ছাত্র মাত্র। এই প্রতারণার বিচার কে করবে? কলেজে পড়ানো হয়নি বলে ছাত্র যদি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয় সে অকৃতকার্যতার দায় কি শিক্ষাবিভাগের ঘাড়ে বর্তায় না? যদি তারা সে দায় নিতে না চান তবে পরিপত্র জারি করে বলে দিলেই পারেন, কলেজে ছাত্রকে ভর্তি হতে হবে, পড়ানোর নামে বেতন দিতে হবে কিন্তু পড়ানো হবে না, পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হলে কলেজের বাইরে কারও না কারও কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে, প্রকৃতপ্রস্তাবে এটাই প্রকৃত শিক্ষানীতি। যাতে এমন পরিপত্র জারি করা হয় সেজন্য পীরছাব অদ্ভুত অনশন করতে নেমেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, অদ্ভুতুড়ে কে বা কোনটি? পীরছাব না আমাদের শিক্ষাবিভাগ অদ্ভুতুড়ে। পীরছাবের আড়াই ঘণ্টার অনশন না কোন বিষয়-না-পড়িয়ে সেই বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া উদ্ভুতুড়ে?