সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাই কোর্ট। এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির রায়ে ১৮৫ জনকে হাই কোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন; বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে ২২৮ জনের। সব মিলিয়ে এ মামলার অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন মোট ২৮৮ জন। অভিযুক্ত ৮৪৬ জন আসামির মধ্যে বাকি ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ সোমবার এই রায় ঘোষণা করে। হাই কোর্টের বিশেষ এই বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
আসামি সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলায় হাই কোর্টের রায় ঘোষণা করা হয় দুই দিন ধরে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আট বছর আগে সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে সংঘটিত বিদ্রোহের পেছনে ছিল ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র’।
জজ আদালতের মত হাই কোর্টও বলেছেন, ন্যায্যমূল্যে পণ্যবিক্রির মত কাজে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে জড়ানো ঠিক নয়।
সেই সঙ্গে কর্মকর্তা ও সৈনিকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, অধস্তনদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিবর্তন এবং তাদের কোনো ক্ষোভ থাকলে তার প্রশমনের তাগিদ এসেছে হাই কোর্টের রায়ে।
বিদ্রোহের আগে গোয়েন্দারা কেন তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছিল- তাও সরকারকে তদন্ত করে দেখার সুপারিশ করেছে হাই কোর্ট।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পরের মাসেই বিডিআরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ঢাকার পিলখানায় বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহী জওয়ানদের হাতে মারা যান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা। রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহে বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে জওয়ানদের বিদ্রোহ। সেই ঘটনা পুরো বিশ্বে আলোড়ন তোলে। এক মামলায় এতো আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও নজিরবিহীন।
রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। সেখানে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদ- হয়। পরে পিলখানায় হত্যাকা-ের মামলার বিচার শুরু হয় সাধারণ আদালতে।
ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে এ মামলার রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়।
জজ আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জন জওয়ান ও নন কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে আটজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চারজনকে হাই কোর্ট খালাস দিয়েছে। সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়াদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
জজ আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়েছে, ১২ জন খালাস পেয়েছে এবং দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
বিচারিক আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া ২৫৬ জনের মধ্যে ২২৫ জনের ক্ষেত্রে আপিল হয়েছিল হাই কোর্টে। তাদের মধ্যে দুই জনের দুটি ধারায় মোট ১৩ বছর (১০+৩) করে, ১৮২ জনের ১০ বছর, আটজনের সাত বছর, চারজনের তিন বছর কারাদণ্ড হয়েছে। হাই কোর্টে ২৯ জন
খালাস পেয়েছেন। ২৮ জনের বিষয়ে আপিল না হওয়ায় তাদের আগের ক্ষেত্রে জজ আদালতের দেওয়া ৩ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রয়েছে। আর জজ আদালতে সাজা হওয়া তিনজন কারাগারে মারা গেছেন।
জজ আদালতে খালাস পাওয়া ২৭৮ জনের মধ্যে ৬৯ জনের বিষয়ে আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। হাই কোর্টের রায়ে তাদের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চারজনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আপিলের ৩৪ জনের খালাসের রায় বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। যাদের বিষয়ে আপিল হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে খালাসের রায়ই বহাল থাকছে। সব মিলিয়ে এ মামলা থেকে খালাস পাচ্ছেন মোট ২৮৮ জন।
হাই কোর্ট যাদের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে, তাদের মধ্যে পিলখানায় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া বিডিআরের উপ সহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমও রয়েছেন।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীকে এ মামলায় যাবজ্জীবন সাজার পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও পাঁচ বছর কারাদ- দিয়েছিল জজ আদালত। তাদের মধ্যে পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে থাকা অবস্থায় হৃদরোগে মারা যান। আর তোরাব আলীকে সোমবার হাই কোর্টের রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এ মামলার হাই কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মোমতাজ উদ্দিন ফকির, মোশাররফ হোসেন কাজল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোশাররফ হোসেন সরদার, শেখ বাহারুল ইসলাম ও জাহিদ সরওয়ার কাজল।
আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল বাসেত মজুমদার, মহসীন রশীদ, এস এম শাহজাহান, এ এস এম আবদুল মুবিন, মো. আমিনুল ইসলাম, দাউদুর রহমান মিনা ও শামীম সরদারসহ আরও অনেকে। আসামিপক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন হাসনা বেগম।
সেদিন যা ঘটেছিল :
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পরপরই পিলখানা বিডিআর সদরদপ্তরে গুলির শব্দ পাওয়া যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভাবছিলেন, কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু কিছু সময় পর জানা যায়- বিদ্রোহ হয়েছে; পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা। বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে পিলখানার চারদিকে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। এদিকে পিলখানার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে শুরু হয় আলোচনা। তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মীর্জা আজম ও সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস এ আলোচনার নেতৃত্ব দেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বিদ্রোহীদের আলোচনা হয়। পরে পিলখানার প্রধান ফটকের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন।
গভীর রাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। তারা মুক্ত হন। কিন্তু এরপরও পিলখানা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে পিলখানা শূন্য হয়ে পড়লে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।
এদিকে বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া গেলে হৈ চৈ পড়ে যায়। বোঝা যায়, ভেতরে হত্যাকা- ঘটেছে। বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।
রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পুনর্গঠন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।