সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
‘হাওরের উন্নয়নে বেশ কয়েক বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। ২০১১ সালে হাতে নেওয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। ২৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২০৩২ সাল পর্যন্ত এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।’ কিন্তু এতো হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও হাওরে কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন নেই। তাই ঠিকাদার নয়, জনগণকে সম্পৃক্ত করে হাওর উন্নয়নে কাজ করতে হবে। কেননা, উন্নয়ন কাজ বা রিলিফ (ত্রাণ) মানেই মজা। আর এ মজা যারা নেন, তাদের নয়। রিলিফ যারা দেন, তাদের মজাই বেশি।’
শনিবার হাওর কনভেনশনে এসব কথা বলেন বক্তারা। রাজধানীর কমরেড মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট ভবনের শহীদ তাজুল ইসলাম মিলনায়তনে কনভেশনের আয়োজন করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।
সিপিবি’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কনভেনশনে বলেন, ‘হাওরে প্রতিবছরই উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। কিন্তু এসব উন্নয়ন কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কেননা, সরকারের কর্মকর্তারা দুর্নীতি করেন। উন্নয়ন কাজের সিংহভাগ টাকা মেরে দেন কন্ট্রাক্টররা (ঠিকাদার)।’
তাই কন্ট্রাক্টরদের দিয়ে কাজ করালে চলবে না। পাবলিক ব্রিগেড গঠন করে তাদের দিয়ে কাজ করাতে হবে। তাদের দিয়ে কাজ করালে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় হবে না। আবার কাজও ঠিকমতো হবে। দুর্নীতির বিষয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাতে জনগণকে দিয়েই উন্নয়ন কাজ করাতে হবে।’
জলমহালগুলোর ইজারা আগামী এক বছরের জন্য বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জলমহালের ওপর হাওরবাসীর অধিকার রয়েছে। কিন্তু ইজারাদারদের লাঠিয়াল বাহিনী সেই পানিতেও নামতে দেয় না। তাই এটা বন্ধ করতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘সরকার পরিবার প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল ও ৫শ’ টাকা ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটি কি হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, একজন মানুষ ৩০ কেজির বেশি ওজন বহন করতে পারেন না। তাই ৩০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের বিবেকবোধ সম্পন্ন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কি করে উন্নয়ন পাবো, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হই।
তিনি বলেন, হাওরবাসীকে যে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, এটি অসম্মানজনক ও হাস্যকর। কেননা, সেখানে প্রতি পরিবারে গড়ে ৫ জন করে সদস্য রয়েছেন। পাঁচজন লোকের তিনবেলা খাবার ১ কেজি চাল দিয়ে কি করে হয়? আর ৫শ’ টাকা খরচ হতে এক সেকেন্ড সময় লাগে। তাই হাওরবাসীকে সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণভাবে সহায়তা দেওয়ার দাবি জানাই।
উন্নয়নকাজে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার দাবিও জানান তিনি।
কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই রিলিফ আসে। কিন্তু স্থানীয় উন্নয়ন হয় না। কেননা, রিলিফে অনেক মজা। আর এই মজা যারা নেন, তাদের নয়। যারা দেন, তাদেরই মজা বেশি।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের নামে যে অবস্থা চলছে, তাতে শঙ্কা হয় যে, হয়তো আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে হাওরে এয়ারপোর্ট, স্টেডিয়াম বা ইটের ভাটা গড়ে তোলা হবে। কিন্তু বিধাতা তো এগুলোর জন্য হাওর বানাননি। কাজেই সেখানকার উন্নয়ন জনগণকে সঙ্গে নিয়েই করতে হবে।’
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এবার হাওরে যে সমস্যা হয়েছে, তা প্রাকৃতিক নয়। এটি মানবসৃষ্ট, কার্যত রাজনৈতিক সমস্যা। তাই এর দায় সরকার বা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় উন্নয়ন করতে হবে।’
প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘তিন দশক ধরে হাওরের উন্নয়নে কাজ করছি। কিন্তু ২৭ হাজার কোটি টাকার মহাপরিকল্পনায় কি আছে জানি না। তবে এ মহাপরিকল্পনা কাদের নিয়ে করা হলো? হাওরের সমস্যার সমাধান হাওরের জনগণকে সঙ্গে নিয়েই করতে হবে।’
কনভেনশনে বাসদের সাধারণ স¤পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এনামুল হক, হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন হাওর অঞ্চলের জেলাগুলো থেকে আসা প্রতিনিধিরা।
বক্তারা বলেন, ‘প্রতিটি হাওরে বাঁধ না দিয়ে পানির উৎসে বাঁধ দিতে হবে। যার একটি ক্যানেল করে মেঘনার সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে হবে। তবেই হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতির মোকাবেলা করা যাবে।’
‘নদীগুলোতে কোনো খনন হচ্ছে না। ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে পাথর-বালিতে নদী-খালের তলা ভরে এসেছে। কাজেই এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সব নদী-খাল খনন করতে হবে।’
কনভেনশনের লিখিত বক্তব্যে সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য সাজ্জাদ জহির চন্দন হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণারও দাবি জানান।