বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধের কাজে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ফসলহানির ঘটনায় সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাকে ওএসডি করে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (ইস্টার্ন রিজিওন) এর দফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে পানিস¤পদ মন্ত্রণালয় বৃহ¯পতিবার প্রত্যাহারের এ আদেশ দেয়। ওইদিনই এ আদেশ কার্যকর করেন পাউবো’র মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর কবির।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা আফছার উদ্দিনকে প্রত্যাহারের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ‘মূলত আফছার উদ্দিনকে ওএসডি করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও পানিস¤পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আফছার উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। রোববার আরও কয়েকজনকে প্রত্যাহার করা হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সচিব (প্রশাসন) ওবায়দুল ইসলাম স্বাক্ষরিত দফতর আদেশে বলা হয়, আফছার উদ্দিন রোববারের মধ্যে দায়িত্বভার হস্তান্তর করবেন। অন্যথায় পরবর্তী কার্যদিবস থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতিপ্রাপ্ত হবেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলামকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় দৈনিক সুনামকণ্ঠকে বলেন, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রত্যাহার করে পাউবো’র প্রধান কার্যালয়ে যুক্ত করা হয়েছে। দ্রুত তাকে যোগদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কেন প্রত্যাহার করা হলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে আব্দুল হাই সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এসময় তার বিরুদ্ধেও ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ উঠে। গত বৃহস্পতিবার দুদক তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর যে ঘোষণা দিয়েছে তাতেও অভিযুক্ত আছেন প্রকৌশলী আব্দুল হাইও।
এ বিষয়ে প্রত্যাহারকৃত সুনামগঞ্জের পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিন শনিবার রাত পৌনে ৯টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, নানা চাপে হেড অফিস আমাকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। প্রত্যাহারের আদেশ হাতে না পেলেও আমি শুনতে পেরেছি। তবে কালকে (আজ) সম্ভবত প্রত্যাহারপত্র পেয়ে যাব। এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিন, পাউবো’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল হাইসহ তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে হাওরের ২৮টি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠায় তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরুর ঘোষণা দেয় দুদক।
কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে সুনামগঞ্জের ৪২টি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে পিআইসি ও ঠিকাদারদের প্রায় ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পিআইসির ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা সংবাদ মাধ্যমকে অবগত করলেও গত ৯ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক বিশেষ সভায় পিআইসিকে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে ২০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী জানান। অভিযোগ রয়েছে তথ্য চেপে এই ১০ কোটি টাকাও লোপাট করা হয়েছে। ওই সভায় জেলার সুধীজন পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী, বিভাগীয় প্রকৌশলী ও সুনামগঞ্জ প্রকৌশলীকে তুলোধুনো করে বক্তব্য রাখেন। প্রকাশ্যে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন তারা। ওইদিন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল হাই ঠিকাদারদের সাফাই গেয়ে পিআইসির কাজে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হন সুধীজন। বাক্যবাণে তারা তাকে বিদ্ধ করেন।
কৃষকদের অভিযোগ, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরুর কথা থাকলেও কাজ শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। তাছাড়া ৪২টি হাওরের মধ্যে প্রায় ১৪টি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজই শুরু হয়নি। বাকিগুলোতে যৎসামান্য কাজ শুরু হলেও সম্পূর্ণ করা হয়নি। কাজ হয়েছে দায়সারা। ফলে গত ২৯ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জে বর্ষণ ও ঢল শুরু হলে হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে। গত ৭ এপ্রিলের মধ্যে জেলার ৯০ ভাগ ফসল তলিয়ে যায়। গতকাল শনিবার রাত পর্যন্ত সরকারি হিসেবে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির ধান। গত ১৩ এপ্রিল সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘেরাওকালে এক সমাবেশে এই ক্ষয়-ক্ষতির কথা জানান, ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের নেতারা। ওই সংগঠনটি গত ১৫ দিন ধরে পাউবো’র দুর্নীতিবাজ চক্র ও ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে জড়িত দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের শাস্তি দাবি করে আসছে।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিন প্রকৌশলী মিলে একটি সিন্ডিকেটকে নিয়ে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের বরাদ্দ লুটপাট করায় এবার বাঁধে কাজ হয়নি। ফলে আমাদের হাওরের সকল ফসল তলিয়ে গেছে। এখন এই ক্ষতির প্রকৃত তথ্যও প্রশাসনিকভাবে লুকিয়ে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। যার ফলে কৃষকরা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হবে। সুনামগঞ্জে ২ হাজার কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতিবাজদের বিচার দাবি করে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি।