1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০১:৫২ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

হাওরের কান্না – ১ : মো. জাফর সিদ্দিক

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭
dav

ক’দিন ধরে ফেসবুকে কিছু লেখালেখি দেখছিলাম। আশঙ্কা, দোষারোপ, অভিশাপ, আতঙ্ক – হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের মেরামত ঠিকমত হয়নি। আকস্মিক বন্যা মোকাবেলায় এসব বাঁধ টিকে থাকতে পারবে তো! না হলে সারাবছরের একটিমাত্র ফসলের দিকে তাকিয়ে থাকা কৃষকের কি হবে? অবশেষে সীমাহীন কষ্ট আর দুর্ভোগের আশঙ্কাই সত্য হল।
দেখলাম সুনামগঞ্জের অসংখ্য হাওরের বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়েছে। বাকিগুলোও নিরাপদ নয়। এসময়ে ফসলহারা দরিদ্র কৃষকদের মর্মবেদনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। আমি ভুক্তভোগী নই। কৃষক, হাওর, পানি এসব থেকে অনেক দূরে। কিন্তু কেন প্রথম দিন টিভিতে খবরটা দেখে দীর্ঘক্ষণ ধরে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সুরমা নদীর অথৈ পানির মত এগুলোও কেন যেন থেকে বাঁধনহারা হয়ে উঠেছিল।
জানি, প্রকৃতির পরাক্রমের কাছে মানুষ কখনো কখনো অসহায় হয়ে পড়ে। দায়িত্ববানদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টাতেও সব দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায় না। তথাপি সংশ্লিষ্টদের কর্তব্যনিষ্ঠা, নিরলস পরিশ্রম এবং পরিকল্পনার ঘাটতি না থাকলে মানুষ দুর্যোগকে দুর্ভাগ্য বলেই মেনে নেয়। অন্যদিকে প্রতিকারহীন ক্ষোভ ভুক্তভোগিদের দুঃখ ও মর্মযন্ত্রণা বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।
ঠিকাদারদের নিয়ে কাজের বিপদ হলো – অগ্রিম না দিলে ওরা কাজ করবেনা; আর অগ্রিম দিলে যথাসাধ্য কাজ কম করে বিল দাখিল করে দেবে। অনেকস্থানে বাঁধের কাজ ঠিকমত না করেই শ্রমিকদের সরিয়ে দিয়ে মাঠ থেকে চলে আসে। একইসময়ে বহুস্থানে কাজ থাকায় পানি উন্নয়ব বোর্ডের জেলা কর্মকর্তাদের পক্ষে সব কাজ সঠিকভাবে তদারক করাও সম্ভব হয় না। অসৎ ঠিকাদার ও প্রকল্প কমিটি এ সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তদারকী সক্ষমতাকেও শক্তিহীন করে ফেলে। মনে হয় এবারের অকাল বন্যা অন্যান্য বারের চেয়ে বেশি অকালে হয়েছে। ফলে ধান কাটার কোন ফুরসৎই কৃষকের মিলেনি। কারণ ধান পাকার আগেই অধিকাংশ হাওর ডুবে গেছে।
মনে পড়ে আজ থেকে প্রায় একযুগ আগে ২০০৪ খ্রি. এ এমনি এক দুর্যোগে আমি সুনামগঞ্জে ছিলাম। ফসল তোলার আগেই যে কোন সময় আকস্মিক বন্যার আশঙ্কায় সবাই তটস্ত। পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সংসদ সদস্য, ইউপি চেয়ারম্যান সবাই বাঁধের কাজ দেখছেন, ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে দায়সারা গোছের। একদিকে হাওরের ভিতর ধান পেকে উঠছে, কাটার অপেক্ষায়। অপরদিকে সুরমার পানি বিপদসীমার অনেক উপরে। দুর্যোগ আসন্ন, কিন্তু ঠিকাদারদের লোকজন কাজ অস¤পূর্ণ রেখেই চলে গেছে। নানা জায়গা থেকেই এরকম উদ্বেগজনক খবর আসছে। অনন্যোপায় হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জেলা অফিস থেকে ঠিকাদারদের তালিকা এনে ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে টেলিফোনে ভয়তীতি দেখানো হলো। কাজটা রীতিসিদ্ধ নয়, তবুও কিছুনা কিছু করার মরিয়া চেষ্টা। এতে কিছুটা কাজ হল। তবে, অনেক ঠিকাদার বেশ কিছু কাজ করলেও বাকিরা বেপরোয়া। সুনামগঞ্জের মূল অধিবাসী হলেও এদের অধিকাংশ সিলেটে বসবাস করেন।
একজনের নাম মনে আছে, তৎকালীন বিরোধী দলের একজন নেতা। ধর্মপাশা-তাহিরপুর এলাকায় বাড়ি। এ ঠিকাদারের হাতে ছিল অনেকগুলো বড় বাঁধের কাজ। তিনিসহ আরো কয়েকজনকে কোনভাবেই মাঠে নামানো গেলনা। অথচ টাকা তাদের পকেটে। পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলীকে বললাম এদের কয়জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কায়দায় কয়েকটা অভিযোগ দিতে। ক’টা গ্রেফতারি পরোয়ানা দিতে পারলে ওদের হয়তো কিছুটা সক্রিয় করা যেত। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইতিহাসে এধরনের রেওয়াজ নেই বলে তিনি সম্মত হলেন না। তারপর মাঠে শুধু ভুক্তভোগী কৃষক, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার, ডিসি, এডিসি, ইউএনও, সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য, পাউবি কর্মকর্তা। সবাই তদারককারী, কিন্তু কারো হাতেই টাকা নেই। টাকা যাদের পকেটে তারা সিলেট শহরে বা অন্য কোথাও। শেষদিকে পাউবো’র কর্মকর্তারাও জনরোষের ভয়ে মাঠে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়।
এরই মাঝে পানি বেড়ে কিছু বাঁধ তলিয়ে গেল। চারদিকে হাহাকার। এ ধরনের কাজে জেলা-উপজেলায় বাড়তি কোন বরাদ্দ নেই। তবুও ইউএনওদের বলা হল উপজেলা তহবিল থেকে সাধ্যমত কাজ করিয়ে নিতে – সরকারি নীতিমালা পরে দেখা যাবে।
যমে মানুষে টানাটানির কথাটা একসময় চালু ছিল। হাওরে চলল একইরকম অবস্থা। কৃষক আর পানিতে লড়াই। এসময়ে জগতে সবচে মূল্যবান বস্তু হল বাঁশ, বাঁশের বেড়া, চাটাই এবং বস্তা। জেলার বড় বাজারগুলোতে এসবের মজুদও ছিল। একসময় পরিস্থিতি এমন হল যে, টাকা নয়, প্রশাসন শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই মহাজনেরা বাঁশ-বেড়া দেবে। টাকা পরে দিলেও চলবে। তারপর শ্রমিক-কৃষক সামান্য পারিশ্রমিক, কিছু খাবার পেয়ে অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রমেই অনেক কাজ করলো। একসময়ে পানির তোড় কমে আসল। যারা শেষ পর্যন্ত লড়াইটা চালিয়ে যেতে পেরেছিল তাদের অনেক বাঁধ টিকে থাকল, অনেকগুলো ধ্বসে পড়ল। ফসল হারানো দরিদ্র কৃষকদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। আরেকটা ফসলের জন্য কমপক্ষে আরো একবছর অপেক্ষা। ঠিকাদারদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি। খোঁজ পেয়েছিলাম সরকার পরিবর্তন হলে হাওরের সেই দস্যু ঠিকাদার নির্বাচিত জননেতা হয়ে দেশসেবা করে যাচ্ছেন। এখন তিনি বিরোধী দলের নন, স্বদলে।
সে সময়কার একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল। হাওর দিয়ে, নদীতে ¯্রােত ঠেলে ¯িপডবোটে ছুটছি। তখনো জেলা সদর থেকে বেশ দূরে, সন্ধ্যা হবার বেশি বাকি নেই। বেলাবেলি ফিরতে হবে, হাওরে রাত মানে মহাবিপদ।
হাওরের নামটা ঠিক মনে নেই, করচার হাওর হতে পারে। দেখা হল একজন মাননীয় সাংসদের সাথে; একটি বিশেষ কারণে যিনি আমার প্রতি ভীষণ বিরূপ। তিনিও আমার মত একই কাজে ঘুরছেন। আমাকে পেয়ে একটা বাঁধে সমস্যার কথা (হতে পারে গুরমার হাওর) আমাকে জানালেন। ‘ওটা কিছু করা যায় কিনা দেখতে পারেন।’
একটা নিরীহ পরামর্শ! বোটের চালক, একজন পুলিশ (দেহরক্ষী) ছাড়া আর কেহ সাথে ছিল কিনা মনে নেই। সতর্কতার জন্য সন্ধ্যার আগে ফিরতে চেয়েছিলাম। তবে, একজন সংসদ সদস্য সমস্যাটা জানিয়েছেন, নিশ্চয় এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আমি গেলে হয়তো কোন উপকার হতে পারে। অন্যদিকে সময়টা ভাল নয়, রাত ঘনিয়ে আসছে। হাওরের বাঁধটি ইতোমধ্যে ভেঙে গিয়ে থাকলে ক্ষুব্ধ কৃষকের হাতে নাজেহাল হয়ে কী লাভ! অথবা মহোদয় কি আসলেই আমাকে সুপরামর্শ দিয়েছেন? ঘটনা সত্যি হলে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অবশ্য খবর না পেলে কোন কথাই ছিলনা। অবশেষে দায়িত্ববোধেরই জয় হল। ফিরে হাওরের দিকে রওয়ানা হলাম। কাছে যেয়ে দেখি একটা বড় বাঁধ ডুবি ডুবি করেও কোনমতে জেগে আছে। ৩০/৪০ জন লোক এখনো এটাকে জাগিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা করছে। ¯পীডবোট দেখে তাদের আচরণ কেমন যেন রহস্যজনক মনে হল। ওদের কয়েকজন কিছু কানাকানি করল তারপর বোটের অপেক্ষায় কিনারে এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে আমাকে নামতে সহায়তা করলেন। তিনি ইউপি চেয়ারম্যান। বললেন, ঠিকাদারদের কেউ কোথাও নেই। পাউবো’র লোকজনও নেই। তিনি কিছু লোকজন নিয়ে এখনো বাঁধটি টিকিয়ে রেখেছেন। এখন আরও কিছু বস্তা, বাঁশ ইত্যাদি যোগাড় হলে শেষ রক্ষা হয় কিনা দেখা যেত। কিন্তু টাকা ছাড়া মহাজন আর কিছু দিতে নারাজ।
আমি প্রতিশ্রুতি দিতে প্রস্তুত। মূলত: গত কয়দিন একমাত্র এ কাজটিই আমি সফলতার সাথে করতে পেরেছি। পদ্ধতিটা হল পানি বাড়ছে, লোকজন নিকটবর্তী গ্রামের কোন উঁচু জায়গা থেকে বস্তায় মাটি ভরে নৌকায় করে বাঁধের উপর একস্তর করে বিছিয়ে দিচ্ছে। একস্তর বিছাতে পারলে বাঁধটা ইঞ্চি ছয়েক উঁচু হয়ে যাবে। পানি বাড়তে থাকবে, আপনি আরেকটি স্তর ফেলবেন। এভাব চলবে পানিবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে। এভাবে পানির বৃদ্ধি থেমে যাওয়া পর্যন্ত টিকে থাকলে আপনি গাজী হতে পারেন নয়তো ‘শহীদ’। বুঝলাম সময়মত প্রতিশ্রুতিও একটা কাজ বটে। তবে, সব জায়গায় এক নিয়ম নয়।
চেয়ারম্যান সাহেবকে লোকগুলোর কানাকানি আর অস্বাভাবিক আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। ঘোর বিপদেও তিনি সলজ্জ হাসিতে মৃদুস্বরে যা জানালেন তা বেশ মজারই বটে। ওরা ভেবেছিল আমি হয়তো পাউবো’র কোন ইঞ্জিনিয়ার। বাঁধের কাছে এলে ওরা ইঞ্জিনিয়ারসমেত বোটটাকে টেনে ডাঙায় তুলে ফেলবে; আর বস্তা-বাঁশ ইত্যাদি যোগাড় না হওয়া পর্যন্ত আর ছাড়াছাড়ি নেই।
ভাগ্য ভাল, ফেরার পথে অন্ধকার হলেও রাস্তা হারাইনি। মনে হয় চেয়ারম্যান আমাদেরকে রাস্তা চেনার জন্য সাথে লোক দিয়েছিলেন। নিরাপদে ফিরতে পেরে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম মাননীয় সাংসদকেও। মনে মনে লজ্জিতও হলাম; মানুষের প্রতি কত সহজেই আমি ভুল ধারণা পোষণ করে ফেলি!
এ মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর জন্য সমবেদনা প্রকাশ ছাড়া যোগ্য কোন করণীয় খুঁজে পাচ্ছিনা। নিজকেও তাদের মতো অসহায় মনে হচ্ছে। পরবর্তী ফসল, সেতো অনেক দূর। ফসলহারা কৃষকের এ মুহূর্তে খাদ্যসহ ব্যাপক সহায়তা প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোকে দুর্গত ঘোষণা করার জন্য সিলেট বিভাগীয় সদরসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি জেলায় দাবি উত্থাপিত হয়েছে। মনে করি, দুর্গত এলাকা ঘোষণা না করেও ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্গতি লাঘবে সরকার বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। এক্ষেত্রে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর, রাজনৈতিক নেতৃবর্গ, স্থানীয় প্রশাসন, জাতীয় এবং স্থানীয় এনজিওসমূহ সমন্বিত প্রচেষ্টা উদ্ভূত পরিস্থিতি উন্নয়নে বিশেষ সহায়ক হতে পারে।
[মো. জাফর সিদ্দিক, সুনামগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক, লেখাটি তাঁর ফেসবুক থেকে নেয়া]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com