1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০১:৩৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

হাওরবাসীর দুঃখের শেষ কোথায়? : এসএম মুকুল

  • আপডেট সময় সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭

অসময়ে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরের কৃষকের সর্বনাশ হয়ে গেল। যে হাওরবাসী বছরে তিন লাখ টন ধান উৎপাদন করে, যারা দেশের ২৫-৩৫ ভাগ দেশীয় মাছের চাহিদা মেটায়, যারা চিরায়ত বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধারণ করে আছেন যুগে যুগে তাদের আজ বড় দুঃসময়। হাওরের চার জেলায় প্রায় দেড় লাখ হেক্টর বোরো ফসল বন্যায় আক্রান্ত। বছরের একমাত্র ফসল কাঁচা অবস্থায় অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে। ফলে হাওরবাসীর বোবা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। উজান থেকে ধেয়ে আসা অকাল বন্যায় হাওরের কৃষকের স্বপ্ন, সাধ, বেঁচে থাকার অবলম্বন শেষ হয়ে গেছে। ঋণের টাকা আর কঠোর শ্রমে যে বোরো ফসল আর ক’দিন বাদে ঘরে তোলার কথা ছিল সেই ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেল। হাওরের কৃষকের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে প্রায় তিন লাখ টন ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য মজুদ বাড়ায়। সেই হাওরের কৃষকরা এখন সারাবছরের খোরাকির জোগানের দুঃশ্চিন্তায় মগ্ন। জীবনযাপনের একমাত্র অবলম্বন এই একটি ফসল নিঃশেষ হয়ে গেল এখন তাদের সংসার চলবে কী করে? যারা সারাবছর ঘরের চাল খেয়ে উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করতেন- এখন তারাই সারাবছর কিনে খাবেন। উপরন্তু তাদের মাথায় আছে ঋণের বোঝা।
আশঙ্কার বিষয় হলো, হাওর উন্নয়নে ২০ বছরমেয়াদি মহাপরিকল্পনা নিলেও তার সুফল পেতে শুরু করেনি হাওরবাসী। দুঃচিন্তার ব্যাপার হলো- চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে। জানা গেছে, বর্তমান সরকার হাওর এলাকার উন্নয়নে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি দেড় শতাধিক প্রকল্প সংবলিত ‘হাওর মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার ধীর বাস্তবায়ন গতির কারণে হাওরবাসীর দুঃখ উজান ঢল রয়েই গেল! মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী হাওরের সাত জেলায় ২৮ হাজার কোটি টাকায় ১৫৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা। ২০ বছরমেয়াদি মহাপরিকল্পনায় নেয়া ১৫৪টি প্রকল্পের ১৪টির কাজ চলছে। ১১টির চলছে সম্ভাবতা যাচাইয়ের কাজ। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত ২০১৪ সালে শুরু হওয়া সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা জেলার ২৯টি হাওরে বন্যা ব্যবস্থাপনার ৯৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা যার অগ্রগতি এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ শতাংশ। যার খেসারত দিচ্ছেন হাওরের মানুষ। এ প্রকল্পের ৮৮ কোটি টাকার আরেক অংশ হাওর এলাকায় গ্রামীণ সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) যা অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। জানা গেছে, এমন প্রকল্পও রয়েছে যার মেয়াদ শেষ হয়েছে কিন্তু কাজের অগ্রগতি ২০ ভাগেরও কম। ৫২টি হাওরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৭০৪ কোটি টাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমির ফসল বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেত। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৭ দশমিক ৯ ভাগ। তারপরেও প্রকল্প মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সড়ক, সেতুর উন্নয়ন এবং গ্রামগুলোকে হাওরের পানির ঢেউয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। ২০১২ সালে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। কিন্তু হাতে দুই বছরেরও কম সময় থাকলেও, প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ৫৬ শতাংশ। আরও জানা গেছে, হাওর উন্নয়নে পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের এলাকা মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী বছর কাজ শেষ হওয়ার কথা। ২০১৫ সালে ৪৩৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও এর ভৌত অগ্রগতি মাত্র ২৯ দশমিক ৯৩ ভাগ। এই হলো হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা।
উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা ঘুচে গেছে কিন্তু হাওরবাসীর দুঃখ রয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এলাকায় এখন মঙ্গাকালীন ফসল ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গা এলাকায় ব্রি-৩৩ ও ৩৯ জাতের ধান আবাদ করে মানুষের খাদ্য সংকট এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপভাবে হাওরের জন্য স্বল্পকালীন ধানের জাত দরকার। যেগুলো প্রতি হেক্টরে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন ফলন দেবে এবং জীবনকাল হবে ১৩৫ থেকে ১৪৫ দিন বা তারও কম। হেক্টরপ্রতি চার থেকে সোয়া চার টন ফলনের স্বল্পকালীন জাত হলেও হাওরবাসীর অকালবন্যায় ফসলহানির অনিশ্চয়তাও ঘোচানো সম্ভব হবে। কম সময়ে উচ্চফলনশীল ধানও উৎপাদন হবে বাংলার হাওরে। তবে আরও ভালো হয় ৯০-১০০ দিনের মধ্যে ঘরে তোলা সম্ভব এমন ধানের চাষাবাদকে হাওরে জনপ্রিয় করা।
হাওরের উন্নয়নে, সমস্যা সমাধানে জনপ্রতিনিধিদের তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। যেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো যেন কেউ নেই! সংসদে তারা হাওরের দুর্যোগ বিষয়ে কথা বলেন না, হাওরের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কোনো উত্তাপ নেই। টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যে রিপোর্টিং হচ্ছে তা আরও ব্যাপকভাবে হওয়া উচিত। আরও অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে টিভি মিডিয়ায় লাইভ হয়। টকশোর আয়োজন হয়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নিউজ আপডেট দেখায়। স্ক্রল নিউজ চলতে থাকে। কিন্তু ৫০ লাখ হাওরবাসীর মানবিক বিপর্যয়ে টিভি মিডিয়ার তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। না আলোচনা আছে না টকশো, না সরেজমিন রিপোর্টিং।
হাওরবাসীর কী দুর্ভাগ্য। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও তাদের দুঃখের সারথী যেন কেউ নেই। এই মুহূর্তে দাবি হলো- হাওর এলাকার দুর্যোগ কাটাতে প্রথমে হাওর এলাকাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হোক। ফসলের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হোক। এই ক্ষতির কারণ বা কারা দায়ী এ বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। হাওরবাসীর জন্য সারাবছর রেশন ব্যবস্থায় চাল, চিনি, ডাল, তেল, লবণ ইত্যাদি ব্যবস্থা করা হোক। আগামী বছরের চৈত্র মাস পর্যন্ত এক বছর এই দুর্যোগ মোকাবেলা কার্যক্রম চালাতে হবে। ফসল বোনার জন্য উন্নত বীজ উদ্ভাবন করতে হবে। যাতে ৯০ থেকে ১০৫ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। জানা গেছে, ভিয়েতনাম থেকে আমন মৌসুমের জন্য আরও পাঁচটি উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের বীজ আনা হয়েছে। যা মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ দিনে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। এ ধরনের ধানকে হাওরের উপযোগী করতে গবেষণা চালাতে হবে।
আগামী বছরের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে হাওরে বীজ বোনার জন্য বীজ সহায়তা ও কৃষির খরচ মেটাতে ব্যাংকঋণ সহায়তা দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়, হাওর উন্নয়ন বোর্ড হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল কম সময়ে উৎপাদনশীল ধানের জাত কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিন, ঋণ সহায়তা দিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। শুকনো মৌসুমে হাওরের পতিত জমিতে হাওরের মাটিতে ফলন উপযোগী সরিষা, মাসকলাই, মসুর ডাল, ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করা হোক। ভাসমান সবজি চাষ, কুটিরশিল্প, গরু-ছাগল (ব্ল্যাকবেঙ্গল)-মহিষ পালন, হাস ও মুরগির খামার প্রভৃতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে হাওরের উন্নয়ন গতিশীল ও টেকসই হবে।
লেখক : কৃষি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com