স্টাফ রিপোর্টার ::
বাঁধের কাজে গাফিলতি, নানা অনিয়ম আর কাজ অর্ধেকেরও কম করার অভিযোগ এবং সুযোগ বুঝেই কেটেপড়া ঠিকাদারের এক্সেভেটর মেশিন আটকে দিয়েছেন ফসলহারা ক্ষুব্ধ কৃষকরা। তাহিরপুরের অধিকাংশ হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে ঠিকাদারদের চরম অনিয়মের অভিযোগ এনে বিভিন্ন স্থানে একাধিক এক্সেভেটর মেশিন আটকে রেখেছেন এসব সাধারণ কৃষক।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, সঠিক সময়ে কাজ না করে শেষ সময়ে এসে কাজ শুরু করে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার অসম্পূর্ণ রেখেই পালিয়েছেন ঠিকাদাররা। আর বাঁধ নির্মাণে কোন ঠিকাদারকেই তারা হাওরে দেখতে পাননি। আসেননি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কর্মকর্তাও। গত বছরের মতো এবারো বাঁধের কাছে ঠিকাদারদের গাফিলতিতে কৃষকের একমাত্র বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এবার কৃষকের অসহায়ত্ব রূপ নিয়েছে তীব্র প্রতিবাদে। আর তাই তাহিরপুরের অনেক বাঁধের কাজে ব্যবহারের জন্য নেয়া ঠিকাদারদের এক্সেভেটর মেশিন আটকে দিয়েছেন ক্ষুব্ধ কৃষকরা।
শুক্রবার তাহিরপুরের শনির হাওরের ত্রুটিপূর্ণ একটি বাঁধ ঘুরে দেখেন এ প্রতিবেদক। সেখানে বাঁধের ৪ ভাগের ১ ভাগ কাজ হয়েছে মাত্র। কৃষকরা জানালেন এ বাঁধটি উপজেলার সাহেবনগর থেকে বেহেলী বাজার পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার। কিন্তু বাঁধে অর্ধেক তো দূরে থাক। কাজ হয়েছে মাত্র আধা কিলোমিটার অংশে। তারপরেও কাজের মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কৃষকরা। নদীর পানির উচ্চতা যখন বাঁধে এসে ঠেকেছে এমন অবস্থায় কাজ ফেলে পালিয়ে গেছে ঠিকাদার এমন কথাই জানালেন কৃষকরা। এসময় ধানের জমি রক্ষার কৃষকরা কাজে লেগে গেছেন নিজেরাই।
আর টানা ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে রাত দিন মাটি কেটে ও বস্তা ফেলে টিকিয়ে রেখেছেন শনির হাওরের বোরো ধান। কৃষকরা জানান, এ বাঁধের কাজ পেয়েছিল পার্থ নামের এক ঠিকাদার। শেষ অব্দি বাঁধের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে হাওর থেকে চলে যায় ঠিকাদারের লোকজন। হাওরের বাঁধের অবস্থা খারাপ থাকলেও ঠিকাদারের কোন খবর নেই। ক্ষুব্ধ কৃষকরা মাটি কাটার যন্ত্র “এক্সেভেটর মেশিন” আটকে রেখেছেন।
স্থানীয় কৃষক মিয়া হোসেন বলেন, ‘হাওরে ঠিকাদারের দেখা আমরা কখনো পাইনি। বাঁধের কাজের যে অবস্থা এটা খুবই খারাপ। অর্ধেকও কাজ হয়নি। আমরা স্থানীয় কৃষকরা রাত দিন মাটি কেটে আমাদের হাওরটা বাঁচিয়ে রেখেছি। ঠিকাদার আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেউ এলাকায় আসেনি।
আরেক কৃষক সিরাজুল হক বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। আমরা এখনো দিন-রাত মাটি কাটছি। আমাদের হাওরটা এখনো টিকে আছে। ঠিকাদারের লোক কোন কাজই করেনি। প্রায় ৫ কিলোমিটার বাঁধের আধা কিলোমিটারও কাজ করেনি ঠিকাদার। এলাকার সব কৃষক এখন তাকে খুঁজছে। পানি বাড়ার সাথে সাথে কাজ ফেলে তার লোকজন এলাকা ছেড়েছে। আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা, মেম্বারসহ অন্যান্যদের নিয়ে আমরা যা পেয়েছি তা দিয়েই আমাদের ফসল রক্ষা করছি। কাজ না করে টাকা মেরে খাওয়া ঠিকাদারদের বিচার চাই আমরা। নইলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাবো’।
কৃষক হুমায়ূন কবির বলেন, ‘আমরা এখন সারা রাত না ঘুমিয়ে বাঁধের কাছে বসে থাকি। দিনে মাটি কাটি। নদীর পানি বাড়ছে। আমরা বিপদের সামনে দাঁড়াইছি। ঠিকাদার আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেউ আমাদের পাশে নাই। আমরাই আমাদের ধান বাচাইতে কাম করছি। ঠিকাদাররা আমরার টাকা মাইরা বড়লোক হয়। আর আমরা কৃষকরা না খাইয়া মরি। এইবার এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিমু।’
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাহেব নগর থেকে বেহেলী বাজার পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ পেয়েছিল সুনামগঞ্জের ঠিকাদার পার্থ। সে কোন কাজ করেনি। আধা কিলোমিটার মাটি ফেলে আর তার খবর নাই। পানি বেড়ে যখন হাওরে ঢুকার উপক্রম তখন স্থানীয় কৃষকরাই নিজেরা প্রায় ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে মাটি কেটে বাঁধ দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাটি ফেলে ও বস্তা দিয়ে হাওরটা তারা টিকিয়ে রেখেছে। আমিও তাদের সঙ্গে সকাল-বিকাল-রাত কাজ করে যাচ্ছি। একবারও ঠিকাদার পার্থ হাওরে আসছে না। এলাকার ক্ষুব্ধ কৃষকরা এখন পার্থ যে এক্সেভেটর মেশিন এনেছিল সেটা আটকে দিয়েছে। পার্থ কাজ না করেই লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার সঠিক জবাবটাই কৃষকরা এখন দিচ্ছে। রাতের অন্ধকারে সে নৌকা দিয়ে মেশিন নেয়ার চেষ্টা করেছিল। খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ কৃষকরা তাকে ধাওয়া দিয়েছে। এরকম বেশ কয়েকটি এলাকায় ঠিকাদারদের এক্সেভেটর মেশিন আটকে দিয়েছে ক্ষুব্ধ কৃষকরা। দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের এসব মেশিন ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য প্রভাবশালীরা কাজ করছে বলে তিনি জানান।’