শামস শামীম ::
হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আসন্ন খাদ্য সংকট তৈরি করে একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারে সংকট তৈরি করে মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার তৎপরতা শুরু করেছে। জেলা প্রতিটি বাজারেই গত ৩-৪ দিন ধরে চাল-ডাল-আটার বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ফসলহারানো কৃষক মুনাফাখোর ও মজুদদারদের এই সংকট তৈরি করে দেড়গুণ মূল্যে চাল ডাল বিক্রি করায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। এদের লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন সুধীজন। তবে প্রশাসন এই সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
এদিকে এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বাজার মনিটরিং কমিটির সভা করে প্রতিটি উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন। মাইকিং করে ব্যবসায়ীদের সাবধান করে জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। প্রশাসন ওএমএস-এর ডিলার বৃদ্ধি ও জেলার বিভিন্ন স্থানে ৪০০ টন চাল বিতরণের জন্য পাঠিয়েছে।
কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ২৯ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল শুরু হয়। এতে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মিত হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে জেলার কৃষকের বেঁচে থাকার অবলম্বন একমাত্র বোরো ফসল আগাম তলিয়ে গেছে। পরে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় একে একে সকল হাওর তলিয়ে গেছে। এতে নিঃস্ব হয়ে গেছেন বোরোর উপর নির্ভরশীল প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কৃষক পরিবারসহ জেলার প্রায় ১৫ লাখ কৃষক। বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিবে এই বিষয়টি বুঝতে পেরে স্থানীয় চালের ব্যবসায়ীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা গোপনে পণ্য মজুদ করে অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করছে। জনগণও আগাম খাদ্য সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে পণ্য ক্রয়ে ঝুঁকে পড়ার সুযোগে এই ব্যবসায়ীরা আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। চালের দাম মণপ্রতি ৫০০-৮০০ টাকা এবং ডালের দাম মণপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দামও হঠাৎ স্থানীয় বাজারে বেড়ে গেছে। বাজার বিশ্লেষকরা জানান, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না বাড়লেও জেলার একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়াকে পুঁজি করে অসৎ ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে মুনাফালাভের কারণে স্থানীয় বাজারে অরাজকতা শুরু করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের চালের বাজারেও ২৮-২৯ চাল ২৪০০-টাকা থেকে ২৫০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এক সপ্তাহে আগে এই চালের দাম ছিল ১৭শ টাকা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, জেলার শাল্লা উপজেলায় গত দুইদিন ধরে চালের সংকট দেখা দিয়েছে। হাওর বেষ্টিত উপজেলার হাওর তলিয়ে যাওয়ায় সামনে অনিশ্চিত জীবনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে লাখো নিঃস্ব কৃষক। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সংকট দেখা দিতে পারে এই ভয়ে যার কাছে যা সঞ্চয় আছে তা দিয়ে চাল-ডাল ও আটাসহ নিত্যপণ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এই সুযোগে শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর বাজার, শ্যামারচর বাজার, ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে চাল, আটা, পেঁয়াজ, মরিচ, তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যের দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে যে চালের কেজি এক সপ্তাহ আগে ছিল ২৮-৪০ টাকা তার দাম এখন ৫০-৭০টাকা। ডালের দাম প্রতি কেজি ১০-১৫ টাকা এবং পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য দ্রব্যমূল্যও বাড়তির পথে। তবে চাল, ডাল আটার মূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে ক্রেতারা জানান।
গত মঙ্গলবার রাতে এ বিষয় নিয়ে জরুরি সভা করেছেন হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগারে অনুুষ্ঠিত জরুরি সভায় কৃষকদের সাময়িক দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ করতে স্থানীয়ভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানোর পাশাপাশি প্রশাসনকে দ্রুত এই সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানানো হয়। জেলা উপজেলাসহ মফস্বলের বাজারে দ্রুত মোবাইল টিম পরিচালনার অনুরোধ জানান সংগঠনের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু। এদিকে একই দাবিতে বুধবার দুপুরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার মিলনায়তনে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুট ও সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র আয়ূব বখত জগলুল। তারাও প্রশাসনের বাজার মনিটরিং কমিটিকে সক্রিয় হয়ে দ্রুত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানান। পাশাপাশি তারা জেলার সকল কৃষকের মধ্যে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রয় করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের কৃষক আব্দুশ শহিদ বলেন, আমার সামান্য যতটুকু ক্ষেত ছিল তা তলিয়ে গেছে। এখন ঘরে খাবার নেই। বাজারে চাল কিনতে গিয়ে দেখি ২৮ টাকার চাল এখন ৪০ টাকা কেজি।
নয়াগাঁও গ্রামের কৃষক প্রীতরাজ চন্দ্র বলেন, ৩৫ টাকা কেজি চাল এখন কিনেছি ৬০ টাকায়। আমাদের এখানকার সব বাজারেই ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করে চাল, ডাল, তেল, আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফসল হারিয়ে কৃষক এখন আরেক নতুন সংকটে পড়েছে বলে জানান তিনি। ব্যবসায়ীরা মজুদ করায় অনেকে দোকানে গিয়েও চাল পাওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি জানান।
মুনাফাখোররা হঠাৎ দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্তি মূল্য নেওয়ায় জেলা প্রশাসন জরুরি সভা করে প্রতিটি উপজেলায় নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। গত দুদিন ধরে ব্যবসায়ীদের অর্থদ- প্রদান করছে। ১১ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে মাইকিংয়ের নির্দেশনা দিয়ে তাদেরকে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় বাজারগুলোতে যাতে ব্যবসায়ীরা এই মুনাফা লুটতে না পেরে সে লক্ষ্যে ডিলারদের মধ্যে প্রায় ৪০০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির জন্য। একই সঙ্গে আরো ডিলার বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়কক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, মুনাফাখোরদের লাগান টেনে ধরতে আমরা প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছি। পাশাপাশি এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে আমরা বিভিন্ন স্থানে পথসভার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, শুরুতেই মুনাফাখোররা কৃষকদের জিম্মি করে তাদের সঞ্চয় হাতিয়ে নিচ্ছে। যত সময় যাবে তারা তত আরো আগ্রাসী হবে। তিনি সুনামগঞ্জের কৃষককে বাঁচাতে দ্রুত সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানান।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কামরুজজামান বলেন, ফসলডুবির ঘটনায় স্থানীয় বাজারগুলোতে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা হঠাৎ চাল ডাল আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ স্থানীয় বাজারগুলোতে ওএমএসর চাল পাঠিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া ডিলার বৃদ্ধির জন্যও প্রস্তাব পাঠিয়েছি আমরা।