মো. জে.এ. সিদ্দিকী
আমার বাড়ির চারপাশেই হাওর। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার সামনেই নজরপুর। এরপরেই সানবাড়ি। সানবাড়ির ঠিক সামনে থেকেই বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরের শুরু। গত দু’দিন থেকে একের পর এক হাওরে পানি ঢুকে ফসল তলিয়ে যাবার কথা শুনছি। বাস্তবতা হলো- বিশাল হাওর অঞ্চলের (সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ) প্রায় কোটি খানেক মানুষের ভাগ্য এক-ফসলি হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওর ভালো থাকলে, কৃষক ভালো।
এক ফসল নিয়েই এখানকার কৃষকেরা ছয়মাস জল এবং ছয় মাস স্থলঘেরা জীবন হেসে খেলেই চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাটি অঞ্চল তার অপার সৌন্দর্য আর সংস্কৃতির সমৃদ্ধতায় অনন্য। রাধারমণ, হাসন, করিম, দূর্ব্বীণ শাহের গান নিয়ে আর মাছ ধরা, নৌকাবাইচ, ঈদ, পূজা-পার্বণে আমাদের ভালোই চলছিল।
গত ৩০ বছরে ভাটির অর্থনৈতিক মেরুদন্ড একদম ভেঙে গেছে। এর প্রধান কারণ বছরের পর বছর কৃষকের একমাত্র সম্বল বোরোধান ভর্তি সোনালি হাওর পানিতে তলিয়ে যাওয়া। এই সুদীর্ঘ সময়ে কখনও শুনিনি হাওরের পাশের কোন নদী খনন করা হয়েছে। জালের মত ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় নদীগুলোর প্রায় সবগুলোই নেমে এসেছে উজানের ইন্ডিয়ার পাহাড় থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত কিন্তু সেই পাহাড়ের আশেপাশেই হয়। এই সময়টাতে চেরাপুঞ্জিতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় বলে শুনেছি। বৃষ্টির সেই পানি সরাসরি নেমে আসে সুনামগঞ্জের হাওরে।
আর আমাদের হাওরের নদীগুলোর অবস্থা!! এইগুলোর নাব্যতা হারিয়েছে সেই কবে! এখন চৈত্রে নাকি এখানকার নদীগুলো হেঁটে পার হওয়া যায়। ছেলেরা নদীতে এখন ক্রিকেট খেলে! তাহলে উজানের পানিতে এখানে নদী উপচে হাওর ডুবাবে না? আমাদের কী তাহলে নদীগুলো খনন করা উচিত নয়? কিন্তু এই কাজটি গত ৩০ বছর বা তারও আগে থেকে কোন সরকারকে করতে দেখিনি। এক প্রেসিডেন্ট তার কোদাল ও মাটি টানার ঝুড়ি নিয়ে খাল খননের যে ছবি দিয়ে বাংলাদেশে কিংবদন্তী হয়ে আছেন, তিনিও এই ভাটির নদীগুলো থেকে এক কোদাল মাটিও তোলেননি। এসবের উপর যুক্ত হয়েছে হাওর রক্ষা বাঁধের নামে টাকা খাওয়ার উৎসব। বাঁধগুলো উঁচু করে দিয়ে, শক্ত করে দিয়ে ফসল রক্ষার কাজ করার মত বোকা (!!) কন্ট্রাকটর বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকেরা না!! তাদের দরকার প্রতি বছর মেরামতের নামে টাকা পকেটে তোলা। হাওরে বৃষ্টিপাত হবে, শিলা বৃষ্টি হবে – সবইতো জানা কথা। কিন্তু হাওর রক্ষার বাঁধগুলো কেন মাঘ মাসে বা পৌষ মাসে হয় না? তারা তা করবেন না। অপেক্ষা করবেন চৈত্রের শেষের অথবা না করেই কীভাবে পার পাওয়া যায়!!
কৃষকের ধান বা জীবন পানিতে তলিয়ে গেলে তাদের কী? সুতরাং একদম শেষের দিকে দু’কোদাল মাটি অথবা একটু ছোট লেয়ার দিয়েই বিল পাস করিয়ে পরের বছরের উৎসবের পরিকল্পনা করো।
গত দু’দিন থেকে আরেক খেলা দেখছি। কিছু রাজনৈতিক নেতা হাওরের বাঁধে বাঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিছু মানুষকেও দেখলাম এদের আগে-পিছে ঘুরছে। খুব সুখের খবর। কিন্তু আমি সুখি হতে পারলাম না। এতদিন কোথাও ছিল আপনাদের মায়া কান্না? এক মাস আগেও কী আপনার মনে ছিল না? তখন কোথায় ছিলেন? মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন?
তখন কেন মসজিদ-মন্দিরে আহ্বান জানালেন না যে, তোমাদের যার যা আছে তা নিয়ে বাঁধের কাজে লেগে যাও। তোমাদের ফসল তোমাদেরই রক্ষা করতে হবে (ধন্যবাদ, ভালোই রাজনীতি করেন – করে যান )!