1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০২:৪১ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

হাওরে কৃষকের ফসলরক্ষার যুদ্ধ

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৭

শামস শামীম ::
হাওরপাড়ের গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা হচ্ছে ‘কৃষক ভাইয়েরা হাওরের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে দ্রুত উড়া কোদাল নিয়ে বাঁধে আসুন। হাওর রক্ষা করুন’। হাওরের হিন্দু-মুসলমান কৃষকের উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা দেয়া হয়। গত ২৯ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে এই ঘোষণার পর হাতে হাত মিলিয়ে ফসলরক্ষার কাজ করছেন হাজারো কৃষক। প্রতি বছর এভাবেই হাওরপাড়ের ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে ফসলরক্ষার যুদ্ধ করেন। হঠাৎ জয়ী হলেও বেশিরভাগ সময়ই পরাজিত হন তারা। বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হাওরের বোরো।
সরকারি হিসেবে গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪৩৪ কোটি টাকা। তবে বেসরকারি হিসেবে এই ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
তাহিরপুরের শনির হাওরের বগিয়ানি, আহম্মকখালি, নান্টুখালি বাঁধ ও আফরমারা বাঁধে গত দুইদিন ধরে হাজারো কৃষক নিয়ে ফসলরক্ষার যুদ্ধ করছেন তরুণ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল। ঝুঁকি নিয়ে পাটলাই নদী দিয়ে যাওয়া দুটি কার্গোর বালু আটকিয়ে বস্তায় ভরে কৃষকদের নিয়ে ফেলেছেন বাঁধে। হিন্দু মুসলিম সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। একজন মাটি খুঁড়ে বস্তা ভরে তুলে দিচ্ছে অন্যজনের মাথায়। একে অপরকে অনুসরণ করে সেই মাটি সারি সারি হয়ে বাঁধে ফেলেছেন কৃষক। সোমবার বিকেল পর্যন্ত যৌথ সংগ্রামে বাঁধটি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। গতবার এই হাওরের সম্পূর্ণ ফসল তলিয়ে চোখের জলে ভেসেছিল কৃষক।
জগন্নাথপুর উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের ৮-১০টি গ্রামের কৃষক গত তিনদিন ধরে সুরাইয়া-বিবিয়ানা হাওরের বালিশ্রী বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। কোনমতে বাঁধে মাটি ফেলে হাওরটি রক্ষা করতে সক্ষম হলেও বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সোমবার সকল থেকে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে ৬টি সেচ মেশিন দিয়ে পানি অপসারণের চেষ্টা করছেন।
রৌয়াইল গ্রামের কৃষক সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, আমরা ৮/১০টি গ্রামের কৃষক গত তিনদিন ধরে বালিশ্রী বাঁধে রাতদিন মাটি কাটার কাজ করছি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্ঘুম কাজ করে আমরা সফলও হয়েছি। এখন চাঁদা তুলে ৬টি সেচপাম্প বসিয়েছি। জানিনা যুদ্ধে জয়ী হতে পারব কি না। তিনি জানান, ফসল মারা গেলে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে কৃষক।
একই গ্রামের কৃষক ছানু মিয়া বলেন, মসজিদের মাইকে বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে ঘরে বসে থাকতে পারিনি। গ্রামের হিন্দু-মুসলিম সবাই ছুটে গেছে বাঁধে। অভুক্ত থেকে কাজ করেছে সারা দিন। কিছুটা সফল হলেও আশঙ্কা কমেনি। তিনি জানান, পার্শ্ববর্তী নলুয়া ও মইয়ার হাওর তলিয়ে গেছে। সেখানকার কৃষকরাও বুরাখালি বাঁধে দুই দিন কাজ করেছে। কিন্তু হাওরটি রক্ষা করতে পারেনি। ফসল হারিয়ে এখন কৃষকরা বিলাপ করছে।
বুরাখালি গ্রামের কৃষক আসাদ মিয়া বলেন, ‘মসজিদর মাইক এলান শুইন্যা শুক্রবার সকালে বান্দে গেছলাম। হারাদিন কাজ করলাম। শনিবারকু বান্দ ভাইঙ্গা আওরটি নিছেগি। ইবারকু কিতা কিতা খাইয়া বাঁচম’ (মসজিদের মাইকে ঘোষণা শুনে শুক্রবার সকালে বাঁধে গিয়েছিলাম। সারাদিন কাজ করেছি। শনিবার বাঁধ ভেঙে হাওর তলিয়ে গেছে। এ বছর কি খেয়ে বাঁচব?)
জামালগঞ্জের হালির হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ কালিবাড়িতে গত দুইদিন ধরে কাজ করেছেন হাজারো কৃষক। বাঁধের কাজে অংশ নেওয়া মাহমুদপুরের কৃষক আব্দুল আলী বলেন, ‘চোরের ফুয়ায় বান্দে মাটি ফালাইছেনা। হেষেদি কিছু মাটি ফালাইলেও মাটি বইছেনা। যার লাগি ঝরিতে বান্দ ভাঙ্গি গিছে। বান্দ ভাঙ্গার খবরে উড়া কোদাল নিয়ে শত শত কৃষক দুই দিন খাঁজ খরলাম। টিকাইতাম পারলাম না।’ (চোরের বাচ্চা বাঁধে মাটি ফেলেনি। শেষদিকে কিছু মাটি ফেললেও মাটি বসেনি। যে কারণে বৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে শত শত কৃষক উড়া কোদাল নিয়ে বাঁধে কাজ করেছি। কিন্তু বাঁধটি টিকাতে পারিনি।)
এভাবেই গত ২৯ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জের ১৩৩ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমির ৩ হাজার কোটি টাকার ফসলরক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে যুদ্ধ করেছেন কৃষক। গতকাল সোমবারও সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, শাল্লা, জগন্নাথপুর ও জামালগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন হাজারো কৃষক। গত ৩০ মার্চ থেকে দিরাই উপজেলার বরাম হাওরের তুফানখালি ও চাপতির হাওরের বৈশাখি বাঁধে কাজ করেও হাওর রক্ষা করতে পারেননি হাজারো কৃষক।
জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ বলেন, অল্পেতুষ্ট কৃষকরা প্রতিনিয়ত স্বেচ্ছায় ফসলরক্ষার সংগ্রাম করলেও তাদের ফসলরক্ষার কোটি কোটি টাকা প্রতি বছর লোপাট হয়। যে ফসল রক্ষায় সংগ্রাম করেন তারা, কিন্তু খুব কমই সফল হন। অথচ তাদের ফসলের বরাদ্দে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় দুর্নীতিবাজরা।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা এভাবে ফসলরক্ষার সংগ্রাম করেছেন। তাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরাও সেই সংগ্রাম করছি। কখনো জয়ী হচ্ছি কখনো পরাজিত। তিনি বলেন বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল শুরু হলেই মসজিদের মাইকে প্রতিনিয়ত কৃষকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেয়া হয় বাঁধে গিয়ে কাজ করতে। এবারও দেয়া হয়েছে। সেই ঘোষণায় এলাকার হিন্দু মুসলমান কৃষক বাঁধে গিয়ে কাজ করেন। আমরা গত তিনদিন ধরে শনির হাওরের বাঁধে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত হাওরটি রক্ষা করতে পারলেও এর পরিণতি জানিনা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com