মো. শাহজাহান মিয়া ::
জগন্নাথপুরে ভারি বর্ষণ ও ঢলের পানিতে চার হাওরের প্রায় ৫০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অবহেলায় হাওর রক্ষা বেড়িবাঁধে কাজ না হওয়ায় এসব হাওর তলিয়ে যায়। চোখের সামনে জমিতে উৎপাদিত বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে কৃষকরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে জগন্নাথপুর উপজেলার সর্ববৃহৎ নলুয়ার হাওর। যে কোন সময় হাওরটি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। যদিও উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রাণপণ প্রচেষ্টায় নলুয়া ও মইয়ার হাওর এখনো তলিয়ে যায়নি। তবে টানা বৃষ্টির পানিতে জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে নলুয়ার হাওরের প্রায় অধিকাংশ জমির ধান তলিয়ে গেছে। এছাড়া এবার চিটা রোগেও ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাতে জগন্নাথপুর উপজেলার নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে অকাল বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে উপজেলার সকল হাওরে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, গতকাল শুক্রবার ভোররাতে জগন্নাথপুর উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের নারিকেলতলা হাওরে ঢলের পানি ঢুকে পড়ে। এ হাওর দিয়ে পানি ঢুকে স্থানীয় কুবাজপুর ও ইছগাঁও গ্রামের হাওরও তলিয়ে যায়। এক দিনে পুরো ৩টি হাওর পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
বিকেল ৩টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, নিজেদের চোখের সামনে জমিতে উৎপাদিত বোরো ধান হারিয়ে হাওর পারে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন কৃষকরা। তারা আহাজারি করে বলছেন, গত বছরও বন্যায় হাওর তলিয়ে যাওয়ায় ধান পাইনি। এবারো ধান পেলাম না। মুখের খাবার পানিতে তলিয়ে গেছে। পরিবারের লোকজনদের নিয়ে কি খাব বুঝতে পারছি না। কৃষকদের এমন আহাজারি দেখে উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-অবহেলার কারণে আমাদের কষ্টার্জিত সোনার ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। তারা যথাসময়ে বেড়িবাঁধে কাজ করলে এভাবে হাওর তলিয়ে যেত না। তারা আরো বলেন, বিগত বছরও একই ভাবে পাকা-আধাপাকা ধান তলিয়ে গেলেও এবার থোড় ধান তলিয়ে গেছে। যার ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, অন্যান্য বছর নারিকেলতলা বেড়িবাঁধের কাজ পিআইস কমিটির মাধ্যমে করা হলেও এবার প্যাকেজের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করেছে। এ বাঁধের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকায় কোন মাটি ভরাট কাজই হয়নি। কাজ না হওয়ায় স্থানীয় কাটা নদীতে ঢলের পানি আসা মাত্র হাওর তলিয়ে যায়। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মাটি কাটার এক্সেভেটর মেশিন নষ্ট হওয়ার অজুহাতে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছেন। এছাড়া বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে জগন্নাথপুর পৌর এলাকার পিংলার হাওরও পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এদিকে, জগন্নাথপুর উপজেলার সর্ববৃহৎ নলুয়ার হাওর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। হাওর রক্ষা বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। সরজমিনে দেখা যায়, নলুয়ার হাওরের সংযুক্ত মইয়ার হাওর রক্ষা বাঁধের ফাটলে বাঁশের আড় বানিয়ে মাটি ভরাট কাজ চলছে। দিন ব্যাপী জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ’র নেতৃত্বে জগন্নাথপুর উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে শতশত শ্রমিকদের দিয়ে বাঁধে কাজ করানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জগন্নাথপুর উপজেলার চিলাউড়া-হলদিপুর ইউপি চেয়ারম্যান আরশ মিয়া ও রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল মুকিত জানান, পিআইসি কমিটি কাজ করলেও প্যাকেজের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথাসময়ে বেড়িবাঁধে কাজ না করায় হাওরে পানি ঢুকেছে। তবে নলুয়ার হাওর রক্ষা করতে বাঁধে দিনরাত কাজ করা হচ্ছে।
জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, এবার জগন্নাথপুরে লক্ষ্যমাত্রার অধিক জমিতে বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে ছোট-ছোট ৪টি হাওর তলিয়ে প্রায় ২০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিগত বছরও কৃষকরা তাদের কষ্টের ফসল গোলায় তুলতে পারেননি। বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এবারো অনেক জমির ধান তলিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত যদি নলুয়ার হাওর রক্ষা হয়, তাহলে তেমন ক্ষতি হবে না।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের জগন্নাথপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী (এসও) সাদেক আহমদ স্বীকার করে বলেন, মাটি কাটার মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে নারিকেলতলা হাওর রক্ষা বেড়িবাঁধের কাজ শেষ করা যায়নি। কাজ শেষ করার সময় না পাওয়ায় নদীতে বন্যার পানি এসে হাওরগুলো তলিয়ে গেলেও নলুয়ার হাওর রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করা হচ্ছে।
জগন্নাথপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেন, যাদের অবহেলায় হাওর তলিয়ে কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতিপূরণ তাদেরকেই দিতে হবে। তিনি বলেন, সরেজমিনে হাওর রক্ষা বেড়িবাঁধ পরিদর্শনকালে কৃষকরা তাদের ক্ষতি পূরণ দাবি করেছেন। আমি তাদের দাবি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরবো।