প্রিয় নতুন প্রজন্মের বন্ধুরা,
স্বাধীনতার মাস শুরু হয়েছে। আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করেছি স্বাধীনতার জন্য। একটু দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিট সময় আমাদেরকে দিন, আমাদের সুখ-দুঃখের কথা বলার জন্য। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ আপনাদের স্বাধীনতার জন্য দিয়েছি, বিনিময়ে মাত্র পাঁচটি মিনিট আপনাদের কাছে চেয়েছি! শুনা না শুনা আপনাদের ইচ্ছা। আমাদের কথা না শুনলে আমাদের তেমন ক্ষতি হবে না, আপনাদেরই হতে পারে। কারণ যে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কথা শুনে না, দাম দেয়না সে জাতির মধ্যে আগামীতে দেশের প্রয়োজনে রক্ত দেয়না। আপনাদের বা আপনাদের ছেলে-মেয়ের যখন প্রয়োজন পড়বে তখন কিন্তু কেউ এগিয়ে আসবেনা।
আমাকে চেনেন? আমি শহীদ রিকশা চালক গণেশের স্ত্রী। আমার স্বামীকে সুনামগঞ্জ কোর্ট প্রাঙ্গণের সামনে মিছিলের সময় পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। আমার স্বামীর রক্তে সুনামগঞ্জ শহর সিক্ত হয়। যৌবনের প্রারম্ভে এক সন্তান রেখে গিয়ে আমার স্বামী দেশের জন্য শহীদ হন। সেদিনের আমার বুকফাটা আর্তনাদ শাঁখা খোলার ও সিঁদুর মোছার করুণ দৃশ্য দেখে তৎকালীন সময়ের সংগ্রামী মানুষেরা আমার সাথে একাত্মবোধ করেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে অন্যতম সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আমি আমার সন্তানের মুখে এক ফোটা দুখ দেওয়ার জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি, আমার সন্তানের ভরণপোষণের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে কাজ করেছি। হায়রে অভাগা দেশ, আমাকে ও আমার সন্তানকে কেউ দুটি টাকা দিয়েও সাহায্য করেনি। জননেত্রী শেখ হাসিনা শুনেছি কোটি কোটি টাকা দিয়ে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সাহায্য করছেন, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমার স্বামী জীবন দিল কিন্তু আমি বা আমার সন্তান কোনো প্রকার সাহায্য আজো পাইনি! অবশ্য এখন আর চাইও না। দুঃখে আমার জীবন গড়া, দুঃখকে লালন করে-শহীদ গণেশের স্মৃতিকে লালন করে শ্মশানে দাহ হতে পারি।
আমার ছেলে তার জীবন দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য তার লাশ তো আমি দেখিনি। ঠিক আছে, তার কবরটা একটু দেখাও বাবা’রা। শহীদের তালেবের মাতা যখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলছিলেন, তখন ছাত্রলীগ অফিসে শহীদ তালেবের মায়ের কান্না দেখে শতশত কর্মী কেঁদে উঠে। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। তার মা’কে বহু চেষ্টা করে সান্ত¦না দিয়ে বাড়িতে পাঠাই। পরবর্তী পর্যায়ে আহসান মারা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে উজানীগাঁও তার কবর দিলে সেখানে তার মা’কে কবর দেখাই। তার মায়ের আর্তনাদে স্কুলের শতশত ছাত্রছাত্রী ও এলাকার জনগণ কেঁদে উঠে, সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
প্রিয় নতুন প্রজন্মের বন্ধুরা, আজকে দেশের পতাকায় যে লাল সূর্য দেখছ তা রহিমা বিবির স্বামী শহীদ আবুল হোসেনের রক্তে রঞ্জিত। সুনামগঞ্জের ডাক বাংলায় প্রথম যে যুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধের প্রথম শহীদ ছিলেন আনসার কমান্ডার আবুল হোসেন।
‘আমার আব্বাকে মেরো না’ —সিতারা।
সুনামগঞ্জের শহীদ বুদ্ধিজীবী সোনাহর আলী সাহেবের কন্যা ও বর্তমান সাংসদ শামসুন নাহার বেগম শাহানার ছোটবোন। কিছু সংখ্যক বিপথগামী পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করে জনাব সোনাহর আলীকে। দশ বছরের সিতারা তার বাবাকে বাঁচানোর জন্য ঐ সেনাদের বারবার পা ধরে বলেছে আমার বাবাকে মেরো না। এই কথা বলার পরও ঐ পাকসেনারা হত্যা করে সিতারাকে।
প্রিয় নতুন প্রজন্মের বন্ধুরা, তোমরা ভরা নদীতে রক্তের ঢেউ দেখনি, ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন দান দেখনি, তোমরা দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত নেওয়ার দৃশ্য দেখনি। এত রক্ত আর ত্যাগে চিরভাস্বর আমাদের এই স্বাধীনতা। তোমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনাসমূহ জানার চেষ্টা কর। মনেপ্রাণে স্বাধীনতাকে বুকে লালন কর। এখানেই শেষ করছি।
আমার ফেসবুকের বন্ধুরা, সত্যিই যদি আমার বন্ধু হয়ে থাকো দেশকে ভালবেসে থাকো তাহলে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজান্মন্তরে ছড়িয়ে দাও। সৃষ্টিকর্তা তোমাদের সহায়।