শিক্ষার যতগুলো পর্ব আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর মাধ্যমিক। এগুলোর মধ্যে দিয়ে যে ভিত্তি তৈরি হয়, তার ওপরই দাঁড়ায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা। সে কারণে এই ভিত্তিকালের পাঠ্য সৃষ্টি, শিক্ষা কার্যক্রম, প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, শিক্ষকদের মেধা ও মনোযোগ এবং রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে।
সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণ করেই যদি শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য মনে করে তাহলে সেটা সঠিক হবে না। বুঝতে হবে এসব বইগুলো শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় কতটা ব্যবহৃত হচ্ছে? সে ব্যাপারে তারা কি কোনো খোঁজখবর নেয়? শিক্ষার্থীদের এসব বই পড়ার সুযোগ এখন কমই হয়। তাদের প্রধানত পড়তে হয় টাকা দিয়ে কেনা গাইড বই। পরীক্ষা বেড়েছে, সিলেবাস বেড়েছে, আর সেই সঙ্গে বেড়েছে কোচিং সেন্টার। সরকারের শিক্ষাব্যয় আনুপাতিক হারে কমে, আর শিক্ষার্থীদের প্রকৃত ব্যয় বাড়ে।
দেশে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত তো বটেই একজন গরিব মানুষকে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে কত যে কষ্ট ভোগ করতে হয় তাতে মনে হয় শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের বুকে পাথর চাপা পড়ে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বাণিজ্যের এক বিশাল জাল। কোচিং বাণিজ্য, তাছাড়া রয়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার পর পরীক্ষা, বইয়ের বোঝা। এই বইয়ের বোঝা শিক্ষার্থীদের টানতে হয়। এই বোঝা টানার প্রতিরোধ আইন হয়েছে। তারপরও থেমে নেই নিত্যনতুন বইয়ের চাপ, ব্যয়ের চাপ।
বর্ণমালা থেকে শুরু করে রং চেনা, ফলু-ফল-পশু-পাখি থেকে গাছ, নদী, মানুষের বৈচিত্র্য, ছড়া, গল্প এগুলোর মধ্যে দিয়ে শিশুর জগৎ খুলে যাওয়ার কথা, সেই জগৎটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই প্রাথমিক বিদ্যালয় আর শিক্ষক। আর এই শিক্ষাক্ষেত্রে চাই যোগ্য শিক্ষক, তাতেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ভিত্তি হবে মজবুত, তার ওপর ভর করেই উচ্চশিক্ষা পর্বের শক্তি দাঁড়ায়। সমাজের গতিমুখ তৈরি হয়।
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা চালুর পর লক্ষ্য করা যাচ্ছে ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে কোচিং। পাঠ্য বইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গাইড বই। শিশুরা শেখার আনন্দ ও সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়াও অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। এছাড়া আছে গাইড বই। গাইড বই আর কোচিং সেন্টার যেন বর্তমান সময়ের স্কুল শিক্ষার দুই স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১০ সালে যখন শিক্ষানীতি প্রথম ঘোষিত হয় তখন ধারণা হয়েছিল যে শিক্ষার্থীদের বইয়ের বোঝা কমবে, পুনবির্ন্যাস করা হবে পুরো কাঠামো অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা হবে, এরপর দ্বাদশ শ্রেণিতে। কিন্তু অজানা কারণেই শুরু হয়ে গেল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী যে পরীক্ষায় অংশ নেয় তার কারণে সুবিধা পেল কোচিং আর গাইড ব্যবসায়ীরা। এ সব দায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক কারোও পক্ষেই টেনে চলা সম্ভব নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার রয়েছে তা রাষ্ট্রকেই দেখভাল করতে হবে। সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষার উপর আরো গুরুত্ব দিতে হবে।