মো. আমিনুল ইসলাম (দোয়ারাবাজার থেকে ফিরে) ::
রাত নামলেই ভয় বাড়তে থাকে গ্রামবাসীর। রাত যতো গভীর হয় পানিতে বুদবুদ আওয়াজ ততোই যেনো স্পষ্ট হয়ে কানে আসে। ঘরের মেঝের ফাঁক ফোকর আর নলকূপের ভেতর দিয়ে বের হয়ে আসছে গ্যাস। তাই নিজের বালিশের কাছে থাকা দিয়াশলাইটা আরো একটু যেন নিরাপদে রাখেন টেংরা গ্রামের সালমা বেগম। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি সালমা বেগমের জীবনের এক স্মরণীয় দিন। এ দিন থেকে আজ পর্যন্ত আতঙ্ক কাটেনি তার। প্রতিটা মুহূর্ত যেনো এই গৃহিণীর কাছে এখন আতঙ্ক। সালমা বেগমের মতো ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটে টেংরা, আজবপুর, খাইয়াজুড়ি, শান্তিপুর, গিরিশনগরের ছয় শতাধিক পরিবারের মানুষের। টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের সুখগুলোও বিদায় নিয়েছে। পরিবারের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত সকলেই। আর সকলেরই বসবাস গ্যাসের সাথে। পুরো এলাকাজুড়েই মাটির ফাটল দিয়ে ক্রমাগত গ্যাস উদ্গীরণ হচ্ছে। বিরূপ প্রভাবটা এলাকায় এমনভাবেই পড়েছে যে স্থানীয় কৃষি জমিতে জন্মাচ্ছে না কোন ফসল। মরছে আশপাশের গাছপালা। বদলে যাচ্ছে মাটির রঙ। এলাকায় বসবাসকারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যাও দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে চোখ আর শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা। বাড়ছে হতাশাও। ক্ষতির দিক থেকে বিবেচনায় এলাকার মানুষ যতোটা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা করেছিলো তার সামান্যটুকুও না পাওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির আশা। তাদের দাবি ‘আমরার শান্তি ফিরাইয়া দেন’। ‘আগুন’ নিয়ে বসবাস করার ভয়ংকর দিনগুলো থেকে মুক্তি চান তারা।
স্থানীয়রা জানান, নাইকো এলাকায় কূপ স্থাপনের নামে ধ্বংস করে দিয়েছে পরিবেশের স্বাভাবিকতা। বর্তমানের বিরূপ পরিস্থিতির জন্য তারা কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোকে সরাসরি দায়ী করছেন। তবে এ ব্যাপারে তৎকালীন সরকারের দায়িত্বশীলতার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তোলেছেন তারা। টেংরা গ্রামের বাসিন্দাদের মতে, এটি শুধুমাত্র তাদের বা দোয়ারা তথা সুনামগঞ্জের ক্ষতি নয়। টেংরাটিলা ট্রাজেডি গোটা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি। আর এ ক্ষতি দিন দিন আরো বাড়ছে।
২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি প্রথম দফায় বিস্ফোরণের পর আবারো একই বছরের ২৪জুন ২য় দফায় বিস্ফোরণ ঘটে গ্যাসক্ষেত্রটিতে। ২শ থেকে ৩শ ফুট উচ্চতায় সে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পেয়েছিলেন সুনামগঞ্জবাসী। কূপের আশপাশের এলাকাজুড়ে শুরু হয় কম্পন।
টেংরা গ্রামের গৃহিণী সালমা বেগম বলেন, ‘আমরা বাড়িঘর ছাইড়া অনেক দূরে চলে গেছিলাম। নিজের জীবন বাঁচানি নিয়া সকলেই আছিলাম চিন্তায়। আমরা আল্লার দিকে ভরসা কইরা বাইচ্চা কাইচ্চা নিয়া মাইনষের বাড়িতে থাকছি। আল্লায় আমরার কপালে কেনে যে এতো অশান্তি দিসিলো? নাইকোর লোকেরা আমরার শান্তি লইয়া গেছে, তারার কাছে আমরা কী অপরাধ করছিলাম? ওখনে খালি সবদিকে আগুন, সরকারের কাছে আমরার একটাই দাবি আমরার শান্তি ফিরাইয়া দেন’।
পার্শ্ববর্তী গ্রাম শান্তিপুরের বাসিন্দা বাবর আলী বলেন, ‘আমরা কোন ক্ষতিপূরণ পাইলাম না। আজকে ১০-১২ বছর হইয়া গেলো আমরার খবর কেউ নিলো না। এলাকার বাড়িঘরের সব গাছ মইরা গেছে, মাটির রঙ বদলাই গেছে, পুকুরের মধ্যে খালি গ্যাস উঠে, ঘরে ভিতরে দিয়া গ্যাস উঠে, ক্ষেতের মাঝে গ্যাস উঠে, আমরার জমিনে ফসলও হয় না, করতাম কিতা? রাইতে পুকুরের মাঝে গ্যাস উঠার শব্দে ঘুমে ধরে না, বাইচ্চার লাগি চিন্তা লাগে, কোন দিকে যে আগুন ধইরা যায় সেই চিন্তায় থাকি’।
আরেক বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই বিস্ফোরণের পরে থাইক্যা এলাকায় আমরা পানির সমস্যায় আছি। কলের মাঝখান দিয়া চাপ দিলেই খালি গ্যাস বাইর হয়, পানিতে খালি আয়রন আর আয়রন। আমরা কয়েক কিলোমিটার দূরে যাইয়া পানি আনি।’
৯নং সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খন্দকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এলাকার মানুষ খুব বিপদের মাঝে দিন কাটায়। সবাই আতঙ্কে আছেন। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পে তাদের আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের জমিতে ফসল না হওয়াতে তারা আরো ক্ষতির সম্মুখীন।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণের পর অনেক গ্যাস পুড়ে গেছে। কিছু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়টি নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখেছি। নাইকো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের মামলা চলমান আছে। কিছুদিন আগে একটি বিশেষজ্ঞ দল এলাকায় পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা তাদের রিপোর্টে খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই বলে জানিয়েছেন। আমি মনেকরি যখন গ্যাস উত্তোলন করা হবে তখন আর এখনকার যে গ্যাস উদগীরণ হচ্ছে সেটা আর থাকবে না।’