সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দর্শক-শ্রোতার ভিড় তেমন নেই। মনোযোগ দিয়ে গান শুনছেন প্রধান অতিথি হাইকমিশনার হোসেন আলী। শিল্পীরা গাইছেন দেশাত্মবোধক গান। আমি উনার কাছাকাছি গিয়ে হাত তুলে সালাম জানালাম। উনি মাথা নাড়লেন। কথাবার্তা হয়নি তবে দু’একবার এমন দেখা হওয়ায় সম্ভবতো মুখচেনা হয়ে আছে। গানের বিরতির ফাঁকে আরেকটু কাছাকাছি এসে সংকোচ ঝেড়ে বলেই ফেললামÑ আমি স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করতে চাই। কিভাবে সেখানে যাব আমাকে কি একটু সুযোগ করে দিতে পারেন। আমিতো কাউকে চিনি না।
বললেন- তুমি কি গান-টান করো?
বললাম- না।
তাহলে কি করবে?
এই যেমন অনুষ্ঠান ঘোষণা, কথিকা পাঠ, খবরও পড়তে পারবো। আবৃত্তিও কিছু করতে পারি। কিছু লেখালেখিও পারি।
ওসব তো অভিজ্ঞতার ব্যাপার। তা না থাকলে কি ওরা নেবে?
আবৃত্তি করতে পারলে এখানে একটা করো।
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি মুখস্থ ছিল। কচিকাঁচার মেলার অনুষ্ঠানে, স্কুলে মাঝে মাঝে আবৃত্তি করতাম। ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের সময় অধ্যাপক আব্দুল মতিনের রচনা ও পরিচালনায় রাজগোবিন্দ স্কুলের পার্টিশনহীন লম্বা শ্রেণিকক্ষে একটি নাটক ও ছায়ানাট্য হয়েছিল। আবৃত্তির জন্য বিদ্রোহী কবিতাটি মুখস্থ করেছিলাম। মনে আছে এখনো। কণ্ঠস্বরও খারাপ নয়। স্কুল কলেজ পাড়ায় বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় আকাশবাণীর দেবদুলাল, ভয়েস অব আমেরিকার কাফে খান রমেন পাইন, বিবিসি’র শ্যামল লুদ, রেডিও পাকিস্তানের সরকার কবির উদ্দিন, ইমরুল চৌধুরীকে অনুসরণ করে খবর পাঠ করতাম প্রায় সময়ই। বন্ধুরা ভালোই মজা পেত, অবাকও হতো। অনুষ্ঠানের শেষদিকে আবৃত্তি সম্পন্ন করে আবার উনার কাছাকাছি আসলাম।
বললেন- বেশ ভালোই করেছ। তবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কোনো বিষয়ে আমি তোমাকে বলতে পারবো না। তুমি টাঙ্গাইলের এমএনএ মান্নান সাহেবের সাথে দেখা করতে পারো। উনি এর দায়িত্বে আছেন। বালু হাক্কাক লেনে জয় বাংলা পত্রিকা অফিসে খোঁজ করলে উনাকে পাওয়া যেতে পারে।
শুরু হল আবার অভিযান। একদিন গিয়ে জয় বাংলা অফিসটি শুধু চিনে এলাম। যাওয়া তো নয়, রীতিমতো যুদ্ধ করা। ক’দিন পর প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম। কি বলবো, কিভাবে বলবো মনে মনে সব ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু উনাকেই পাওয়া গেল না। কোথায় আছেন কেউই তা জানে না। স্বাধীন বাংলা বেতারের ঠিকানা কারো কাছ থেকে বের করা গেল না। আরো দু’একদিন আসা-যাওয়ার পর পাওয়া গেল। অনেক ব্যস্ততা। অনেকের সাথে কথা বলছেন। আলাপ-আলোচনার ধরণ দেখে বোঝা যায় কেউ কোনো অভিযোগ বা নালিশও করছেন। কেউ কিছুটা উত্তেজিত, কেউ আবার বিনয়ের সাথে খরচাপাতির টাকা-পয়সাও চাচ্ছেন। উপস্থিত দু’একজনের সাথে কথা বলে বুঝলাম বেশির ভাগই টাঙ্গাইলের লোক। এটাই স্বাভাবিক। বিদেশ বিভুঁইয়ে বিপদে পড়ে নেতার কাছেই তো আসবে। ঘণ্টা দুয়েক বসলাম। আমি যে একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে পারি তা হয়তো বিবেচনায়ই নিচ্ছেন না। লোকজন কিছুটা কমে এলে সাহস করে সামনে গিয়ে মনোবাসনা ব্যক্ত করলাম। একটু অবাক হলেন। উনি এর দায়িত্বে থাকলেও বেতার সংশ্লিষ্ট সংগঠকেরাই রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা চট্টগ্রাম রাজশাহী রংপুর কেন্দ্রের শিল্পী, কলাকুশলী বা অন্যান্যদের যোগাযোগ করে নিয়ে এসে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত করছেন। প্রশ্ন করলেনÑ তুমি তো ছাত্র। কি পড়ো। বললাম- ইন্টারমিডিয়েট। ভ্রু কুঁচকালেন। মনে হল বিশ্বাস হচ্ছে না। আগ বাড়িয়ে বললামÑ কলেজে পড়ার প্রমাণপত্র আছে।
তা থাক। তোমার তো এ লাইনে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর আজ যখন সুযোগ পেয়েছি তাহলে এদিক-সেদিক একটা করেই ছাড়বো, এমন মনোভাব নিয়েই এতোক্ষণ বসেছিলাম। যদিও অর্বাচীন বালকের ধৃষ্টতা বলে বিবেচিত হতে পারে। তবুও বললামÑ স্যার, আমাদের কারোরই তো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না। তবুও তো যুদ্ধ চলছে।
টেবিলের উপর কাগজপত্রে মনোযোগ উনার। এবার চোখ তুলে তাকালেন। বিরক্ত বা অসন্তুষ্টির কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। আমাদের এমএনএ, এমপিএদের জিজ্ঞেস করলেন। বললাম এমএনএ দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী, এমপিএ আব্দুজ জহুর।
– উনারা কি তোমাকে চিনেন?
– বললাম, খুব ভালো চিনেন। দ্রুত কাগজপত্র গুটিয়ে উঠে যেতে যেতে বললেনÑ উনাদের কাছ থেকে একটা পরিচয়পত্র নিয়ে এসো। আমাদের সাংসদেরা যে সুদূর মেঘালয়ে আর সহসা এমন পরিচয়পত্র আনা সম্ভব নয় তা বলার সুযোগ পেলাম না। তবুও সাফল্যের একধাপ অতিক্রম করতে পেরেছি ভেবে উৎফুল্ল চিত্তে বেরিয়ে এলাম। কাছাকাছি কোনো কলেজ আছে কিনা খুঁজতে খুঁজতে খেয়াল হল সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এখন তো কলেজ ক্যান্টিন খোলা থাকার কথা নয়। সস্তায় চা-সিঙ্গারা খাওয়া যায় কলেজ ক্যান্টিনে। নাইট শিফট থাকলে হয়তো ক্যান্টিন খোলা থাকবে। তা থাক। অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। ক্লান্তিও ভর করেছে। এবার ঘরে ফিরি। কত নম্বর বাস কোন দিক দিয়ে যায় ফুটপাতের দোকানির কাছে জেনে নিয়ে বাসে চাপলাম। আজ আর ঝোলাঝুলিতে নেই। দরজার ভিড় ঠেলে একটা সিটে বসার চেষ্টা করছি। বাসে উঠে সিটে বসা এমন অভিজ্ঞতা এর আগে দু’তিনবারের বেশি হয়েছে কিনা ঠিক হিসাব করতে পারলাম না। আগেভাগেই কনডাক্টরের দিকে হাত বাড়িয়ে বললামÑ একটা দশ নয়া।
মাথায় তখন পরিচয়পত্রের চিন্তা ভর করেছে। যতটুকু জানি জহুর সাহেব থাকেন ট্যাকেরঘাটে। আর দেওয়ান সাহেব শিলং-বালাট দু’জায়গাতেই যাতায়াত করছেন। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পত্রযোগাযোগ আছে। ধরে নেই, যেতে আসতে পনেরদিন করে একমাস। উনারা কখন বালাট আসবেন আর তা সংগ্রহ করতে ধরে নিলাম আরো ১৫ দিন। দেড় দুই মাসের ব্যাপার। উৎসাহ হারানোর পক্ষে যথেষ্ট। বালাটে কার কাছে লিখবো, কি লিখবো তা ভেবে ভেবে আরো দু’চারদিন কাটলো। কোনো ফাঁড়িপথ পাওয়া যায় কিনা তাও খুঁজছি। আমার ধারণা ছিল, স্বাধীন বাংলা বেতারের সম্প্রচার হয় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকেই ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে। দু’দিন সেদিকে গেছি। রীতিমতো বাংকার বানিয়ে সেনা প্রহরা। প্রথম দিন আটকে দিল এনট্রি পাস নেই বলে। দ্বিতীয় দিন বললাম, এনট্রি পাস নেই, তবে রিজিওনাল ডাইরেক্টরের সাথে জরুরি প্রয়োজন, দেখা করতে যাব। আমাকে দেখে হয়তো, এমন কোনো প্রয়োজনের লোক বলে গ্রাহ্য করলো না। তাই আবেদন নামঞ্জুর। যুদ্ধাবস্থার মতো সতর্ক প্রহরা। বার বার এখানে এভাবে আসলে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা অভিযুক্ত হতে পারি Ñ এই ভয়ে তৃতীয় বার আর অমুখো হইনি। একটা কবিতা লিখে রেখেছিলাম, পকেটেই থাকতো। বাংলার ডাক নামে স্বাধীন বাংলার একটা পত্রিকার খোঁজ পেয়ে তাদের কাছে সেটি দিয়ে এসেছিলাম প্রকাশের জন্য। ছাপা হয়েছে কিনা সেটি জানার জন্য পরে আর সেদিকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কবিতাটিকে একটু অদল-বদল করে ‘লাঞ্ছিতা জননীর ছিন্ন আঁচলেÑ রক্ত আঁচড়ে লাল সূর্য এঁকে’ এরকম একটি গানের আকারে লিখে আকাশবাণীর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। পোস্টাল অ্যাড্রেস জানা ছিল। বিবিধ ভারতীর মনের মতো গান, কলকাতা কেন্দ্রের অনুরোধের আসর শোনার নেশা ছিল অনেকদিন ধরে। অনুরোধ পাঠানোর জন্য ঠিকানা বলে দেয়া হতোÑ প্রযতেœ, আঞ্চলিক পরিচালক, আকাশবাণী ভবন, ইডেনগার্ডেন কলকাতা-১। আমি পৌঁছতে না পারলেও ডাকে ছাড়া চিঠিতো আর আটকাবে না।
কলকাতা শহরজুড়ে কলেরার আতঙ্ক। প্রবল বর্ষণ আর ড্রেনের ময়লা আবর্জনা একাকার হয়ে ওলিতে গলিতে হাঁটুজল জমে থাকে। চোখে জয়বাংলা রোগের প্রাদুর্ভাবও রয়েছে। ভয় এ দুটোর জন্যই। তবে আমি আক্রান্ত হলাম জ্বরে। পরীক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পড়লো টাইফয়েড। শয্যাশায়ী রইলাম দুই সপ্তাহ। পুরোপুরি সুস্থ হতে আরো সপ্তাহ দশদিন। শুশ্রƒষার অভাব ছিল না। ডাক্তার, ঔষুধপত্র চলছিল যথারীতি। ভগ্নিপতির মেডিকেল কলেজে যোগাযোগসূত্রে একটু বেশিই চিকিৎসা পেয়েছি। উপযুক্ত পথ্যেরও অভাব নেই। বিছানায় পড়ে ভাবছি, আমি তো একটা আশ্রয়ে আছি। বৃষ্টি জল কাদায় মাখামাখি হয়ে ক্যাম্পে যারা আছে তারা অসুখে বিসুখে কি করছে, কতো মানুষই তো কলেরা, রক্ত আমাশয়ে মরছে। বাড়ি ঘর ছেড়ে এসে অপরিচিত জায়গা, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত কী অসহায় মানুষ। দুর্বল শরীরে শুয়ে শুয়ে অলস সময় কাটাচ্ছি। একদিন সার্ভিস লেখা অল-ইন্ডিয়া রেডিও’র একটা খাম আমার ঠিকানায় এলো। জ্বর কমে এসেছে সবে। উঠে বসতে পারি কেবল। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম। সম্ভবত কাজ হয়েগেছে। দুর্বলতায় ভর করা কাঁপা হাতে খামটি খুলে দেখলাম, একটি ইংরেজি টাইপ করা চিঠি এবং সংযুক্তিতে আমার লেখাটি। আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে দুঃখপ্রকাশ করে বলেছেনÑ যেহেতু আমি তাদের নিবন্ধিত গীতিকার নই, তাই এ গান প্রচার করা সম্ভব নয়। হতাশ হলাম বটে। যে জায়গায় একাধিক বার চেষ্টা করেও ঢুকতে পারিনি সেখানকার কর্তৃপক্ষই পত্রে ধন্যবাদ জানিয়েছে, দুঃখপ্রকাশ করেছে তাতে একটা সান্ত¦নাবোধও আছে। চেষ্টা করলে একটা কিছু হবে এ ভরসাও জাগলো। কিন্তু আমি যে ক’দিন যাবৎ গৃহবন্দি। সকল কার্যক্রম বন্ধ। (চলবে)