যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়েছে। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছিল এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে দখলদার বাহিনী ও তার দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে। বিজয়ের ঠিক দু’দিন আগে দেশ ও বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের সহায়তায় বুদ্ধিজীবীদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। দেশের বরেণ্য শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, চিকিৎসক গোলাম মুর্তুজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর, মনসুর আলীসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এবং যুদ্ধ চলাকালে হত্যা করা হয় জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে। মুনীর চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ ও শহীদুল্লাহ কায়সারও একইভাবে হত্যার শিকার হন। আর এই নারকীয় হত্যাকান্ডের সর্বপ্রথম শিকার হয়েছিলেন অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত ডিসেম্বর মাসে আমরা যাদের হারিয়েছি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের অধিকাংশই ছিলেন খ্যাতিমান। যুদ্ধে চারদিক থেকে কোণঠাসা হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা রাজধানীসহ মূলত শহরাঞ্চলে ঘৃণ্য হত্যাকান্ড চালায়। ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জনের ফলে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আমাদের জন্য তা ছিল মহত্তম অর্জন। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ অনেকটাই বিষাদে পরিণত হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের কারণে। এসব বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহীদ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন দেশ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এই বুদ্ধিজীবীরা বাঙালির বিকাশে নব্য পাকিস্তানের অসারত্ব তুলে ধরেছিলেন। পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও শোষণের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। তাঁরা এমন একটি সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যা পরাধীনতার অন্ধকার থেকে দেশকে নিয়ে যাবে আলোর ভুবনে। এ কারণেই তাঁরা ঘাতকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম আর বিজয় অর্জনের পথে তাঁদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। যে চেতনার জগৎ তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, সেই চেতনা থেকেই আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। আমরা মনে করি, এই দিবস পালন সবচেয়ে সার্থক হবে তখনই, যদি আমরা সেই চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করি এবং সেই চেতনার যথাযথ বাস্তবায়নে কাজ করে যাই। স্বাধীনতাবিরোধীরা নানা কৌশলে সেই চেতনার জগতে আঘাত হানতে চাইবে, কিন্তু চেতনা রক্ষায় আমাদের সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থেকে প্রগতিবিরোধী চিন্তাচেতনাকে সচেতনভাবে বর্জন করতে হবে। তাহলেই স্বপ্নের সোনার বাংলা পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।