1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:০৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ঝরাপাতার পান্ডুলিপি : শরর্ণাথী ৭১

  • আপডেট সময় রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শৈশব থেকেই জেঠামশাইয়ের খাটে শোবার অভ্যেস। প্রথমত গল্প শোনার জন্য। পরে সেটিই নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত জেঠামশাই বলে যেতেন রামায়ণ-মহাভারতের গল্প। হস্তিনাপুর, কুরুক্ষেত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতো। ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, পা-ু, যুধিষ্ঠির, দ্রৌপদী চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে যেন আমার একান্ত পরিচিত মনে হতো। ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধন, দুঃশাসন দুরাত্মা হলেও কেবল জেঠামশাইয়ের মতো অন্ধ হওয়ার কারণে বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র আমার সহানুভূতি অর্জন করে নিয়েছিলেন। কৌরবপক্ষের বীর ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য্য, কর্নের যুদ্ধবিদ্যার প্রতি আমার বিস্ময়ভরা সমীহ। তাদের পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন। মনে হতো জন্মাবধি দৈব লাঞ্ছিত কর্নের প্রতি যদি এতো অবিচার, এতো প্রতারণা করা না হতো তাহলে হয়তো কৌরবেরাই যুদ্ধে জয়ী হতো। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সইতে হতো না শতপুত্রের শোক। কত ছলচাতুরি করেই না ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য্য, কর্নের মতো বীরদের পরাস্ত করা হয়েছে। সবই তো শ্রীকৃষ্ণের পক্ষপাত আর চাতুরি। সেখানে অর্জুনের কি এমন কৃতিত্ব, ভীমের কী বাহাদুরি। জেঠামশাই বলতেনÑ তা না হলে যে ধর্ম রক্ষা হতো না।
ভোরে হাড়গিল (হাওয়াল) পাখির ডাকে ঘুম ভাঙত। জেঠামশাই জেগে যেতেন আরো আগে। আমার জাগরণ নিশ্চিত হয়ে বিশাল হাতের তালু পিঠে বুলাতে বুলাতে শুরু করতেন মেঘনাদবধ কাব্যের কোন এক সর্গ। চতুর্দশপদী অমিত্রাক্ষর ছন্দের সে কাব্যরস ঝরে পড়ত ভোরের শিশির ঝরার মতোÑ
যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার,
প্রিয়তম বীর-কূল-সাধ এ শয়নে
সদা ! রিপুদল বলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়! শতধিক তারে।
আমগাছের ফাঁক গলে সকালের রোদ যখন সামনের বারান্দায় জমতে থাকে জেঠামশাইয়ের সমবয়সী বন্ধু ঠাকুরবাড়ির সুরেন্দ্র চক্রবর্তী তখন এসে বারান্দায় তার নির্দিষ্ট আসনে বসে রয়েছেন। বেতের পাটি পেতে ছোট তোষক এবং চাদর বিছিয়ে হেলান বালিশ দিয়ে জেঠামশাইয়ের বসার জায়গা করে দেওয়া হতো। দিনের অধিকাংশ সময় এখানেই কেটে যেত।
দু’বন্ধুর আলাপ শুরু হতো পূর্ব দিনের খাবারে কার কি আয়োজন ছিল, তা নিয়ে। বিশুদ্ধ বাংলা শুধু নয়। আলংকারিক শব্দ প্রয়োগে চলতো নিভৃত পল্লীর দু’বন্ধুর কথোপকথন। মধ্যাহ্নের আহারে কে কয় গ-া মাছ ভাজা, কয়টা মাছের মুড়ো, শেষ পাতে অম্বল না দধি। পূর্বাহ্ণে বিরুনান্নের সাথে দুগ্ধ তো অবশ্যই তৎপূর্বে কি পরিমাণ ঘৃত সহযোগ ইত্যকার আলোচনায় তখনকার মতো কোন শ্রোতা থাকতো না। জ্যেষ্ঠমা কাসার দু’টি বাটিতে চিনেমাটির পেয়ালা বসিয়ে চা দিয়ে যেতেন। উপরিভাগে ঘন সরের আস্তরণ।
সান্ধ্য বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল দেশত্যাগের। আমি আসায় তা আরো দৃঢ় হয়ে সময়ও নির্দিষ্ট হয়েছেÑ আগামীকাল সকাল। যেতে যখন হবেই তখন দেরি করে বিপদ ডেকে আনার কোন যুক্তি নেই। পুরাতন ব্রাহ্মণ গ্রামের অনেক হিন্দু পরিবার আগেই চলে গেছে। আজও কয়েকঘর গেছে। ক’দিন ধরে দূর থেকে ধুম-ধুম গোলাগুলির আওয়াজ খুব শোনা যাচ্ছে।
আজ আর রাতের সংবাদ শোনার জন্য অপেক্ষা না করে চোখে মুখে বিষাদের কালোছায়া মেখে সবাই যার যার বাড়ি চলে গেছে, দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিতে। গ্রামের অধিকাংশ লোকজনই গরিব, প্রান্তিক চাষী। দৈন্যদগ্ধ জীবন। সহায় সম্পদ বলতে খানিক কৃষিজমি, বসতবাটি, গবাদিপশু, বাঁশঝাড়, গাছপালা, তৈজসপত্র, সংসারের খুঁটিনাটি। তা যত সামান্যই হোক অনেক কালের জমানো, অনেক কষ্টের অর্জন, হয়তো বাপ ঠাকুরদা’র কত স্মৃতি লেপ্টে আছে এইসবে। কারো ক্ষেতে বৈশাখের কাঁচা-পাকা ধান। কারো গোলায় অগ্রহায়ণের কিছু ধান মজুদ। দু’চারদিন খাবারের মতো চাল-ডাল, নগদ টাকা-পয়সা যদি থাকে সঙ্গে নিতে হবে। কারো টিন থাকলে তা নিতে পারলে ভালো হয়, সঙ্গে বাঁশের খুঁটি। বালাটে শিবির তৈরি শুরু হলেও তাৎক্ষণিক তা পাওয়া যাবেনা। অন্তত মাথাগোঁজার একটা ঠাঁই তো তৈরি করা যাবে।
পূর্বদিকের ঘরে কিছু যুবা তরুণ যারা এতক্ষণ বাঁশের লাঠি, কোচার ফলা, সুলফি ঝাঁটা নিয়ে যাত্রাপালার মহড়ার মতো গ্রাম পাহারার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারাও বেরিয়ে গেল। এ ব্যবস্থা চালু আছে বেশ ক’দিন ধরে। নদীপথ পাহারা দেয়া হতো এপ্রিলের প্রথম থেকেই। ছাতক থেকে নদীপথে পাঞ্জাবি আসলে এদিক দিয়েই আসবে। সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ ছিল সন্দেহজনক নৌযান দেখা গেলে তা যেন দ্রুত সুনামগঞ্জের কার্যালয়ে অবহিত করা হয়। নদীর পাড়ে গর্ত করে বাংকারের মতো বানিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রাতজেগে পালা করে পাহারা দিত গ্রামের লোকজন। হতদরিদ্র কৃষক, স্বাধীনতার অর্থ তাদের কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। ঘুম থেকে উঠেই কয়েকটি ক্ষুধার্ত মুখের আহার যোগানোকে যারা জীবনের একমাত্র ব্রত মনে করতো অজোগ্রামের সেই সহজ-সরল মানুষগুলো। স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনালগ্নেই স্বাধীনতার অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি অর্থ নিজেরাই আবিষ্কার করে নিয়েছিল, সেটি দায়িত্ববোধ। এ পাহারায় কখনো কোন শৈথিল্য ছিল না। তবে আজ আর সে পাহারা নেই। সংগ্রাম পরিষদ নদীর উত্তরপাড়ে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে।
সবাই চলে যাওয়ায় হঠাৎ করেই একটা নীরবতা যেন গ্রাস করে নিল গ্রামের রাতটিকে। নিজ গৃহের পরিচিত শয্যা, নিশ্চিত আশ্রয় আজ রাতেই বুঝি শেষ। যদিও অধিকাংশের জীর্ণ কুঠিরে বর্ষায় চাল চুইয়ে জল, ভাঙা বেড়ার ফাঁকে হাওয়ার আনাগোনা, চাঁদের আলোর উঁকিবুকি, তবুও স্বপ্নের রঙে রাঙানো নীড়, এতটুকু আশ্রয় তাও বুঝি আর রইল না।
রামায়ণ-মহাভারতের গল্প বলার মতো অবস্থা এখন নেই। জেঠামশাই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য বাংলার মতো আর কোন রাজ্য এবং বাঙালি হিন্দুর মতো কোন সম্প্রদায় এতো মূল্য দেয়নি। প্রাপ্তির ঘরে শূন্য। শতবর্ষের দূরত্ব অতিক্রম করে অন্তঃস্থিত গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জেঠামশাই বলতে শুরু করলেনÑ কত সংগ্রাম, আন্দোলন, বিপ্লব। কত জেল, ফাঁসি, দিপান্তর অতিক্রম করে স্বাধীনতা এলো। তারপর একপক্ষকে চলে যেতে হলো জন্মভূমি ছেড়ে। কারণ ১৪ আগস্টের পর এদেশ আর তাদের রইল না। রাতারাতি তারা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে গেল। স্বাধীনতা যখন প্রায় নিশ্চিত, ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ থেকে উপনিবেশ গুটিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই জিন্নাহ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ডাক দিলেন। বিলাত থেকে আসা মন্ত্রী মিশনের সাথে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় পাকিস্তানের দাবি ঝুলে থাকে। মরিয়া হয়ে লেড়কেলেঙ্গে পাকিস্তানের জন্য মুসলিম লীগের এই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ঘোষণা। ছেচল্লিশের ১৬ আগস্ট, সেই দিনের ডাইরেক্ট অ্যাকশনে একটি ফুলের আঘাতও ইংরেজদের গায়ে লাগলো না। উপরন্তু কলকাতায় শুরু হয়ে গেল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ল চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, পাবনা, ময়মনসিংহে। নোয়াখালিতে আরো ভয়াবহ আকারে। অবিভক্ত বাংলায় তখন মুসলিম লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। অভিযোগ রয়েছে সোহরাওয়ার্দীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও সরাসরি নির্দেশে এমন দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। সত্যাসত্য যাই থাক সরকার প্রধান হিসেবে তিনি এর দায় এড়াতে পারেন না। দাঙ্গা ক্রমে ভয়াবহ রূপ নিলে সোহরাওয়ার্দী ঘাঁটি গাড়েন লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। সেখানে বসে তিনি কি নির্দেশ দিচ্ছিলেন তা স্পষ্ট না হলেও স্বয়ং ফজলুল হক বলেছিলেনÑ কন্ট্রোল রুম কিছুই কন্ট্রোল করছে না। ইংরেজদের স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক পাকিস্তান দাবির সমর্থক। সেই পত্রিকাতেও এই আদিম হিং¯্রতার জন্য দায়ি করা হল মুসলিম লীগ মিনিস্ট্রিকে। বলা হল এ দাঙ্গা পূর্বপরিকল্পিত। কলকাতার ছোট লাট দিল্লির বড় লাটের কাছে বার্তা পাঠালেনÑ এ পর্যন্ত যা খবর পাওয়া গেছে তা স্পষ্টত সাম্প্রদায়িক, কোন ক্রমেই ব্রিটিশবিরোধী নয়। দাঙ্গার জের আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে বিহার ও পাঞ্জাবে। এই দাঙ্গাই মূলত দেশভাগ চূড়ান্ত ও ত্বরান্বিত করে দেয়। গান্ধী দেশভাগ মেনে নিলেন। বাঙালি বুক চিড়ে বিভক্তিরেখা টানতে গান্ধীর দায়ও কম নয়। বাংলাকে সারা ভারতের ভয়। সুভাষ বসুর উত্থান গান্ধী সহ্য করতে পারেননি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফ্ফার খান, রফি আহমদ কিদওয়াই, জাকির হোসেন, আসামের মুসলিম লীগ নেতা সাদউল্লাহ সহ সর্বভারতীয় অনেক মুসলমান নেতা দেশভাগের পক্ষে ছিলেন না। এমন কি জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ্ প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক দলগুলোও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ঘোরতর বিরোধী। যাই হোক তিন টুকরোয় দুই ভাগে বিভক্ত হল দেশ। দু’ভাগে অসহায় দুই সম্প্রদায়কে বলির পাঠা হিসেবে জিইয়ে রেখে দু’টি পৃথক দেশের লাশ কাঁধে নিতে দু’পক্ষের নেতারাই তড়িঘড়ি শুরু করেন। বাঙালির সেই দুর্দিনে যখন সুভাষ বোসের বড় বেশি প্রয়োজন তখনই তাঁর অন্তর্ধান। সুভাষ থাকলে হয়তো বাঙালির এ দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। (চলবে)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com