1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ঝরাপাতার পান্ডুলিপি : শরণার্থী ৭১

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬

(পূর্ব প্রকাশের পর)
আমরা উদ্বাস্তু নই। ৭১-এর শরণার্থী। সাময়িক আশ্রয়প্রাপ্ত। আমাদের জন্য ভারত সরকারের কোন দায় নেই। অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটাপন্ন ভারত, তবুও লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয় দিচ্ছে। নিউজ উইকের প্রতিনিধি টনি ক্লিফটনের ভাষায়Ñ “ভারত অলৌকিকভাবে তাদের আশ্রয় ও আহার যোগাচ্ছে।” উদ্বাস্তু বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক আর শরণার্থী সমস্যাটি আপাত মানবিক। পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীর চাপ সবচেয়ে বেশি হলেও তাদের কেউ বাঙ্গাল বলে না। বলে জয়বাংলার লোক। আশ্রিত হলেও একটা সমীহ আদায় করা ভাব। আমরা তোমাদের এখানে থাকতে আসিনি। আমরা যুদ্ধ করছি স্বাধীনতার জন্য। আবার ফিরে যাব মুক্ত স্বাধীন একটি নতুন দেশে।
কয়েকটি পোস্টকার্ড ছাড়া হল বিভিন্ন ঠিকানায়। সপ্তাহ দশ দিনের আগে কোথাও চিঠি পৌঁছার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ আগামী সোমবারের আগে এখান থেকে পরিত্রাণের কোন ভরসা আপাতত নেই। কাছাকাছি কোথাও নিজেদের লোক বলতে তেমন কেউ নেই। ষোল অতিক্রমণের অনুসন্ধিৎষ্ণু মনে ভালোলাগা পাহাড়, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত লোকজনদের সাথে ভিন্ন পরিবেশে একত্রে থাকা, যুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থান, নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা আমার কাছে কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের মত মনে হলেও বৃদ্ধ মা বাবা ও অন্যদের দুর্ভোগ চিন্তায় উদ্ধারকারী হিসাবে নিকট আত্মীয়দের জন্য প্রতীক্ষা ক্রমে তীব্রতর হল।
তখনও মেঘালয় রাজ্য হয়নি। আসামের খাসিয়া এন্ড জৈন্তা হিলস্ জেলার ছোট্ট একটি জনপদ। পুলিশস্টেশন, বিএসএফ ফাঁড়ি, পোস্ট অফিস, পিডাব্লিউডি’র সাবডিভিশন এ নিয়েই এতোদিন একইভাবে চলে আসা বালাট যেন দ্রুত বদলে যেতে লাগলো। পাহাড়ি জনপদের নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ করেই সৃষ্টি হল চাঞ্চল্য। সরকারি লোকেরা সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত। নাম রেজিস্ট্রেশন, পরিবারপিছু রেশনকার্ড আরো কত উঠকো ঝামেলা। বাজারের বিক্রি-বাট্টা বেড়ে গেল কয়েক গুন। ট্রাকের পর ট্রাক আসছে চাল-ডাল-তেল-আটা নিয়ে। আসছে সবজি। মাছ, মুরগী, ডিম আসছে ওপাড় থেকে। ট্রাক, ট্রলি বোঝাই বাঁশ, চাটাই, ত্রিপল। বাজারের উত্তর দিকে সমতল ভূমি, এর মাঝেই একদিন বাঙালি আর খাসিয়া-গারোদের ফুটবল খেলা হয়ে গেছে। এখন সেখানে শুরু হয়েছে শিবির তৈরির কাজ। অনেক বাঙালি শ্রমিকের কাজ জুটে গেছে। ফ্রি রেশনের সাথে বাড়তি কিছু আয়। শিলং-গৌহাটি থেকে সরকারি কর্মকর্তারা আসছেন পরিদর্শনে। মুজিবনগর সরকার গঠন হয়ে গেছে সপ্তাহখানেক আগে। যোগাযোগের জন্য আমাদের এমএনএ, এমপিরা যাতায়াত করছেন শিলং-বালাট। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের আনাগোনাও শুরু হয়েছে। বালাটের পরিবেশও বদলে গেল। বিরল বসতির বালাট এবং আশেপাশের তিন চার মাইল পর্যন্ত এ অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা দুই হাজারের মত। কিন্তু শরণার্থীর সংখ্যা বিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রকৃতির সবুজ অরণ্য ছাপিয়ে বালাট পরিণত হলো জনারণ্যে। মাইলাম, পানছড়া, লালপানি তখন অপেক্ষা করে আছে আরো কয়েক লক্ষ শরণার্থীর।
নিকট অতীত – দূর অতীত :
বালাটে এসে দু’চার দিনের প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার পর নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা ছাপিয়ে যে দুঃশ্চিন্তাটি প্রবল হয়ে উঠেছিল তাÑ গ্রামের বাড়ির জন্য। গ্রামের লোকজন সকলেই তখন রয়েগেছে। আমাদের জেঠামশাই, জ্যেষ্ঠমা রয়েগেছেন বাড়িতে। বিভিন্ন দিক থেকে এখন গ্রামের লোকজনই বেশি আসছে। বিচলিত হওয়ার আরেকটি কারণÑ এটি সম্পূর্ণ হিন্দু গ্রাম। ছোট হলেও এমন জনপদে পাঞ্জাবিদের হিং¯্রতার মাত্রা যে অনেক বেশি হবে তাতে সন্দেহ নেই। খবর নেয়া বা পাঠানোরও ব্যবস্থা নেই। কাউকে না পেয়ে অবশেষে স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে, পরিবারের সবাইকে উদ্বেগে রেখে নিজেই আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে সুনামগঞ্জমুখী হলাম। শরণার্থীর ¯্রােত বেড়েই চলছে। আমি উল্টো পথের নিঃসঙ্গ যাত্রী। নিজের মনেও ভয়, কিন্তু বাড়িতে রয়ে যাওয়া জেঠামশাই, জ্যেষ্ঠমা’র কথা মনে হলে ভয়-শঙ্কা ছাপিয়ে তাদের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার বাসনাটাই প্রবল হয়ে উঠে। জন্মের পর মাতৃদুগ্ধ, জল-হাওয়া, যে সকল প্রাকৃতিক উপাদানে আমার বেড়ে উঠা, সেই সাথে আরেক অনিবার্য অনুষঙ্গ জেঠামশাই, জ্যেষ্ঠমা’র ¯েœহ ও মমতা। শৈশব থেকে এ দু’জনের ¯েœহাদরের প্রশ্রয়ে কৈশোর অতিক্রম।
চলতি নদীতে অনেক খালি নৌকা ভাটির ¯্রােতে ফেরত যাচ্ছে। যে কোনটিতেই চড়ে বসা যায়। কিছু নৌকায়, কিছু পথ হেঁটে শহর বরাবর নদীর উত্তরপাড়ে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পিটি স্কুলের আস্তানা গুটিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং সংগ্রাম পরিষদের নেতারা নদী পেরিয়ে চলে এসেছেন। পাঞ্জাবিরা ছাতক দখল নিয়েছে। তাই নিরাপত্তার জন্য শহর ছেড়ে সুরমার উত্তরপাড়ে রঙ্গারচর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এসে ঘাঁটি গাড়া হয়েছে। দিনটি ছিল ২৮ এপ্রিল। শুভাকাক্সিক্ষ কেউ কেউ এ মুহূর্তে শহরে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বুঝলাম বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। তবুও শঙ্কা আর ভাবনার দোলায় দুলতে দুলতে নদী পেরিয়ে শহরে উঠলাম। দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা, নীরবতার এক রহস্যময় চাদর জড়িয়ে পুরো শহরটি কেমন গুটিসুটি মেরে আছে।
গ্রামের রাস্তা সাইকেল চালানোর তেমন উপযোগী না হলেও সঙ্গী বিবেচনায় একটি সাইকেল সংগ্রহ করে নিলাম। ষোলঘরে আমাদের বাসা অতিক্রম করেই বাড়ি যাওয়ার পথ। তবুও থামলাম না। সপ্তাহ খানেক ধরে খালি পড়ে থাকা বিষণœতায় আচ্ছন্ন বাসাটিকে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলাম। আশেপাশের সকল বাসাই জনশূন্য।
আমি ছুটছি আমার গাঁয়ের পথে। এক সময় ব্রাহ্মণগ্রাম বলতে একটি গ্রামই ছিল। সেই কবে, হয়তো মধ্যযুগের কোন এক সময়ে কি কারণে যেন পূর্বপুরুষদের একপক্ষ একটি আমন কিত্তা ও ছোট চারাখালি বিল পেরিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে নতুন গ্রামের পত্তন করেছিলেন। সেই থেকে এটি নতুন ব্রাহ্মণ গ্রাম। উত্তরে বহমান সুরমার দিঘল বাঁক নদী পথে দু’গাঁয়ের দূরত্ব অনেক বাড়িয়ে দিলেও দক্ষিণে আমন ক্ষেত পেরিয়ে সহজেই এগাঁও-ওগাঁও করা যায়। মাসখানেক আগে পাঞ্জাবির সাথে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের সময় শহরের অনেক পরিবার দল বেঁধে ষোলঘর চৌমোহনা থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে মাইজবাড়ি পেরিয়ে পুরাতন ব্রাহ্মণগাঁওয়ের ভদ্রবাড়ি, ধরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। চৌমোহনা থেকে উত্তরদিক বরাবর ধোপাখালি পেরিয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে নতুন ব্রাহ্মণ গ্রামের সেনবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল আরো কয়েকটি পরিবার। প্রায় দুই সপ্তাহ বাড়িগুলো হয়ে গিয়েছিল একেকটি আশ্রয়শিবির। শহরতলির অনেক বাড়িতে তখন একই অবস্থা। ডাল-ভাতের অভাব ছিল না। মাছের পাতলা ঝুলও হতো। ভাড়ারে ক্ষেতের ধান, ডালও মজুদ। ভাগালুরা যখন ধান কাটতে আসতো, নৌকা বোঝাই করে মুগ, মসুর, মাসকালাই, খেসারি ডাল সহ তেঁতুল, শুকনো বরই, পেঁয়াজ, গুড় আরো কত কি নিয়ে আসতো। গৃহস্থ পরিবারে সারা বছর অনুমানের খোরাকি রেখে দেওয়া হতো। আশ্রয়গ্রহণকারীদের মধ্যে বৃদ্ধ, শিশু, নবজাতকসহ প্রসূতিও ছিল। প্রয়োজনানুসারে দুধের বরাদ্দ ঠিক করে দিতেন জ্যেষ্ঠমা। আমরাও তখন সুনামগঞ্জের বাসা ছেড়ে বাড়িতে। কেউ কেউ বাসা-বাড়ি করছি। (চলবে)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com