আজ থেকে শুরু হলো বাঙালির বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি নিজস্ব একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ অর্জন করে। পাকিস্তানের শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করতে বাঙালিকে চরম মূল্য দিতে হলেও বাঙালি জাতীর সবচেয়ে মহোত্তম ও গৌরবময় অর্জনও এই স্বাধীনতা। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম। একাত্তর সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারও আগে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ উচ্চারণ ছিল- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
মহান বিজয়ের মাসের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাই।
বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই দলে দলে তরুণ-যুবারা সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলার সশস্ত্র প্রস্তুতি শুরু করে বাঙালি। শামিল হতে থাকে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। আর বাঙালিদের এই স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধং দেহী মনোভাব থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ¯পষ্ট বার্তা পেয়ে যায়- বাঙালিদের দমন করা যাবে না। তাই ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইটের বাস্তবায়ন করে তারা। যা ছিল বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা দমনে তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। এরপর থেকে বাঙালির প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করার। লড়াইয়ে মুক্তিকামী জনতার রক্তে আরো প্রগাঢ় হয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। অসম সাহসে, জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। সংগ্রাম চলাকালে মুক্তিসেনারা দেশের কোথাও না কোথাও শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত করেছে। এভাবে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এগিয়ে আসে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, যখন মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর। ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মহান বিজয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ।
বিজয়ের এ মাসে দাঁড়িয়ে বলতেই হয়, প্রায় সাড়ে চার দশকের ইতিহাসে এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের নানা খাতে প্রভূত উন্নয়ন ও দেশ নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশবলয়ে অবস্থান করলেও দেশ নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে নেই। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপশক্তি কৌশলে রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সক্রিয়। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি। পাশাপাশি সরকারকেও এদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে নিতে হবে আরো কঠোর ব্যবস্থা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাঙালির কষ্টার্জিত অর্জন ধরে রাখতে এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের সব শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করলে, পার¯পরিক হানাহানি ভুলে একযোগে কাজ করলে, দেশটি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে এমনটি সংশয়হীনচিত্তে বলা যায়।
আমাদের প্রত্যাশা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আরো ত্বরান্বিত এবং রায় কার্যকরের যথাযথ উদ্যোগ নেবে রাষ্ট্র। এছাড়া সারাদেশে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো যেমন ধরে রাখার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিতেরও উদ্যোগ নিতে হবে। মুক্তিসংগ্রাম যেমন আমাদের অনিঃশেষ এক অনুপ্রেরণার নাম তেমনি দেশ থেকে অপশক্তির মূলোৎপাটনই হোক বিজয়ের মাসের অন্যতম অঙ্গীকার।