সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
একাত্তরের নৃশংস হত্যাকারী বাহিনী আলবদর নেতা ও জামায়াতের অর্থ জোগানদাতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে কাশিমপুর কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ষষ্ঠ অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হলো।
পরে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামানও কারাগার থেকে হয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, রাত সাড়ে দশটায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০ মিনিট তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
রিভিউ রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ফাঁসি দড়ি এড়াতে মীর কাসেমের সামনে একটাই পথ ছিলো রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। শুক্রবার (০২ সেপ্টেম্বর) আইজি প্রিজনের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি ক্ষমা চাননি। শনিবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারাগারে পৌঁছায় মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর করতে সরকারের নির্বাহী আদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে আদেশও তাকে পড়ে শোনানো হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
এরপর বিশেষ কারা বার্তাবাহকের মাধ্যমে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জন এবং কারা মহাপরিদর্শকের কাছে অবহিতকরণ চিঠি পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। একই চিঠি পাঠানো হয় মীর কাসেমের গ্রামের বাড়িতেও।
বিকেলেই মীর কাসেমের স্ত্রী-মেয়ে-পরিজনকে শেষবারের মতো তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠায় কাশিমপুর কারাগার কর্তৃপক্ষ। বিকেল চারটা ৪৫ মিনিট থেকে ছয়টা ০৮ মিনিট পর্যন্ত ৩৮ জন স্বজন কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে এক ঘণ্টা ২৩ মিনিট সময় ধরে শেষ সাক্ষাৎ করেন।
রাতে কনডেম সেলে গিয়ে মীর কাসেমকে গোসল করিয়ে রাতের খাবার দেওয়া হয়। এরপর কারাগারের মাওলানার মাধ্যমে তওবা পড়িয়ে নেন কারা কর্তৃপক্ষ। এ সময় তার কাছ থেকে তার শেষ কোনো কথা থাকলে তাও শুনে নেন কারা কর্মকর্তারা।
এরপর ধর্মীয় রীতি অনুসারে কাসেমকে তওবা পড়ান কাশিমপুর কারা জামে মসজিদের ইমাম মুফতি হেলাল উদ্দিন। এর আগেই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা স¤পন্ন করেন কারা চিকিৎসক ডা. মিজান ও ডা. কায়সার।
কারা কর্মকর্তারা তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে মীর কাসেমকে জানিয়ে দেন। তারা বলেন, ‘এটাই আপনার শেষ রাত। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।’
মুফতি হেলাল উদ্দিন তাকে বলেন, ‘আপনার কৃতকর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃতকর্মের জন্য তওবা করেন।’ এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট চারেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন।
রাত পৌনে দশটার দিকে তারা মীর কাসেমকে নিয়ে যান ফাঁসির মঞ্চে। আগে থেকেই মঞ্চের পাশে রাখা ছিল মরদেহ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স।
ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার পর তার মাথায় পরানো হয় একটি কালো রংয়ের টুপি। এই টুপিটিকে বলা হয় ‘যমটুপি’।
ফাঁসির মঞ্চে তোলার পর কাসেমের দুই হাত পেছন দিকে বাধা হয়। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন কারা কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট। ফাঁসির মঞ্চে প্রস্তুত ছিলেন জল্লাদও। মঞ্চে তোলার পর তার দুই পা বাধা হয়। পরানো হয় ফাঁসির দড়ি।
কারা কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল একটি রুমাল। রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেন। লিভারটি টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁসির মঞ্চের নিচে চলে যান মীর কাসেম আলী। এ সময় মাটি থেকে ৪-৫ ফুট শূন্যে তাকে ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘাড়ের হাড় ভেঙে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়।
মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর মরদেহ তোলা হয়। এরপর কারা চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কুমার ও ডা. আহসান হাবিব, গাজীপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার খানের তত্ত্বাবধানে ময়না তদন্ত স¤পন্ন করেন। এ সময় তার ঘাড়ের রগ কাটা হয়।
মীর কাসেম আলীর ফাঁসির লিভারে টান দিয়ে ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালন করেন প্রধান জল্লাদ শাহজাহান। অন্য তিনজন দীন ইসলাম, রিপন ও শাহীন জল্লাদ ছিলেন তার সহযোগী।
ফাঁসি কার্যকর করার সময় ফাঁসির মঞ্চ ও কারাগারের ভেতরে ছিলেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজি প্রিজন) কর্নেল ইকবাল হাসান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম, পুলিশ সুপার হারুনুর রশিদ, সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার খান, কাশিমপুর কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, জেলার নাশির আহমেদ। মঞ্চের চারপাশে ছিলেন ২০ জন কারারক্ষী।
চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণের পর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার দায়ে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। এটা ছিল কাশিমপুর কারাগারে কোনো যুদ্ধাপরাধীর প্রথম ফাঁসি।
মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারসহ সংলগ্ন এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সন্ধ্যায় পুরো কারা চত্বর মূল ফটক ঘিরে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চারদিকে চার স্তরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিভিন্ন বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়।
কারাগারসহ পুরো গাজীপুর জেলাজুড়ে ছিলেন সাড়ে চারশ’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। পুলিশের পাশাপাশি ছিলেন র্যাব, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ ও কমিউনিটি পুলিশ সদস্যরা।
গাজীপুর জেলাজুড়ে ছিলেন চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য। বন্ধ করে দেওয়া হয় কারাগারের সামনের সড়কে সাধারণ যান চলাচল ও আশেপাশের সমস্ত দোকানপাট।