সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
‘আমি চির বিদ্রোহী বীর / বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!’ নিজের লেখা অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এমনই আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন বিপ্লব, সাম্য আর মানবতার কবি। নিজের ক্ষুরধার লেখনীর আঁচড়ে স্থান করে নিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যে। পদ্য, গদ্য, উপন্যাস, সংগীত-সাহিত্যের সব শাখায় তার আগমন ছিল ধূমকেতুর মতো। বাংলা সাহিত্যে তার আগমন প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের এক গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন- ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
আজ শনিবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম প্রয়াণবার্ষিকী। বাংলা ১৩৮৩ সালের আজকের এই দিনে (২৯ আগস্ট, ১৯৭৬) সারাজীবন অপরাজেয় কবি হেরে যান মৃত্যুর কাছে। শরীরী পদচারণা না থাকলেও বিধাতার সৃষ্টি এই ভুবনে শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় আজও তার ‘উন্নত মম শির’। আজকে এ সময়ে দাঁড়িয়ে সেজন্য বলতে হয়, কাজী নজরুল এখনও প্রাসঙ্গিক। অন্তত শোষণ আর বঞ্চনা মুক্তির ক্ষেত্রে।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তার ডাকনাম দুখু মিয়া। নিজের ডাক নামের মতোই দুঃখে ভরা ছিল তার জীবন। দারিদ্র্য আর লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছোটবেলাতেই তিনি যোগ দেন লেটো দলে। মূলত লেটো দলে যোগদানের মাধ্যমেই সাহিত্যচর্চা অঙ্কুরিত হয়। এই দলের বিভিন্ন নাটকের জন্য তিনি গান ও কবিতা রচনা করেন। নজরুলের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় মক্তবে।
দারিদ্র্যের কারণে মাত্র দশ বছর বয়সেই পরিবারের ভার বহন করতে হয়েছে তাকে। রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী এই কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। সক্রিয় রাজনীতি করার কারণে বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় তিনি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। এসব সাহিত্যকর্মে সা¤্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সু¯পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তার বিশেষ স¤পর্ক থাকলেও নিজেকে কখনোই সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে বন্দি করেননি। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি ও বিদ্রোহী। ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধেও তিনি কলম ধরেছেন। ‘অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতোই তাঁর প্রকাশ’ – যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনেও। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। এই দুই সাহিত্যকর্ম বাংলা পদ্য ও গণসংগীতের ধারাকে স¤পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে।
এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী কামাল পাশা’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’সহ প্রত্যেকটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছিল।
শুধু কবিতাতেই নয়, সংগীত রচনায় নজরুলের অসাধারণ প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে স¤পৃক্ত করেছেন ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে। দুর্বোধ্য ও আভিজাত্য নিয়ে চলা রাগনির্ভর গানকে ভেঙেচুরে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করেছেন। রাগ-রাগিণীকে নিয়ে দারুণভাবে খেলিয়েছেন গানে গানে। এক রাগের সঙ্গে অন্য রাগের মিলন ঘটিয়ে সংগীতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। রাগ-রাগিণী নিয়ে এই ভাঙা-গড়ার খেলায় ‘মীনাক্ষী’, ‘দোলনচাঁপা’র মতো নতুন অনেক রাগের সৃষ্টি করেছেন তিনি। এক কথায় বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে সৃষ্ট নজরুল সংগীত বাংলা সংগীতের এক অপার বিস্ময়।
ছোটগল্প, উপন্যাস, সংগীত, নাটক লিখলেও মূলত কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। তিনি তার কবিতার পঙ্ক্তিমালায় তুলে ধরেন নিপীড়িত মানুষের কথা। নির্বাক কবিতাকে তিনি মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা প্রদান করেন। কবি-সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক পরিচয়ের বাইরে রাজনীতিবিদ ও সৈনিক হিসেবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন নজরুল।
এপার বাংলা আর ওপার বাংলা – দুই বাংলাতেই কাজী নজরুলের গান আর পদ্য সমানভাবে সমৃদ্ধ। তার প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেনÑ ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/বাঙালি বলতে একজন আছে/দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।’
১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেয়া হয় একুশে পদক।
কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে সেখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি নজরুল কবিতার পঙক্তিতেই তুলে ধরেছিলেন নিজের অন্তিম ইচ্ছা। লিখেছিলেনÑ ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই,/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’ সেই বিবেচনাতেই কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।