শামসুল কাদির মিছবাহ ::
চোখ যেদিকে যায় শুধু পানি আর পানি। এমনই নয়নাভিরাম দৃশ্যের হাতছানি দেয়া জোয়ালভাঙ্গা হাওরের পাড়ঘেঁষে যে স্কুলটি দাঁড়িয়ে আছে তার নাম রাঙ্গামাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের রাঙ্গামাটিয়া গ্রামে স্কুলটির অবস্থান। নয়নাভিরাম দৃশ্যে স্কুলটির অবস্থান হলেও স্কুলে যাতায়াতে দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে যায় শিক্ষার্থীদের। গ্রামের মাটির ভাঙ্গাচোরা সড়ক দিয়ে বছরের প্রায় ৬মাসই পানি-কাদা মাড়িয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। আর বাকি ৬মাস পায়ে হেঁটে। বর্ষায় নৌকাই যাতায়াতের একমাত্র বাহন। আর হেমন্তে পায়ে হেঁটে। গ্রামের পুরোটা জুড়েই কাঁচা সড়ক। তাও ভাঙ্গাচোরা। বিদ্যুৎব্যবস্থাও পৌঁছেনি প্রত্যন্ত এই এলাকায়। ফলে এই এলাকার শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কোনো সীমা নেই। গ্রামে একটি মাত্র ফেরি নৌকা চলাচল করে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর পর নৌকা ফেরি করে। সময় মতো নৌকা ধরতে না পারলে ক্লাস মিস।
এছাড়া নানা সমস্যা রয়েছে স্কুলটিতে। স্কুলের টিউবওয়েল প্রায় বছরখানেক ধরে বিকল হয়ে আছে। অনেক দূরের টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয় শিক্ষার্থীদের। বিদ্যুৎ না থাকায় অসহ্য গরমের মধ্যে ক্লাসে হাঁপিয়ে ওঠেন ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দ। ১২৭জন ছাত্র-ছাত্রীর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন তিনজন।
গতকাল সোমবার সরেজমিন এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ এলাকাবাসীর সঙ্গে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আরিফা আক্তার জানায়, নৌকা ধরতে না পারার কারণে প্রায় দিনই সঠিক সময়ে স্কুলে যেতে পারি না। বিশেষ করে পরীক্ষার সময় বেশি টেনশনে থাকতে হয়।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র পাভেল জানায়, পানি-কাদার জন্য স্কুলে যেতে খুব কষ্ট হয়। বর্ষায় সড়ক পানিতে ডুবে থাকে। তাই সড়কের ভাঙ্গাচোরায় পড়ে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায়ই আহত হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী কুলসুমা জানায়, বর্ষায় মাটির সড়ক দীর্ঘদিন পানিতে ডুবে থাকে। পরে পানি কমে গেলে বৃষ্টির পানিতে রাস্তার বেহাল অবস্থা তৈরি হয়। এ অবস্থা দীর্ঘদিন থাকে। পানি-কাদা মাড়িয়ে স্কুলে যেতে মন চায় না। মনে সব সময় গর্তে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
স্কুলের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান, হাফিজুর, লিজাসহ সকল শিক্ষার্থীর বক্তব্য প্রায় একই।
রাঙ্গামাটিয়া গ্রামের বাসিন্দা জহুর মিয়া বলেন, আমাদের এলাকার রাস্তা-ঘাটের বেহাল অবস্থা। গ্রামের কয়েক কিলোমিটার সড়ক কাঁচা হওয়ায় শহরে যাতায়াতে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাঁটু পানি মাড়িয়ে স্কুলে যেতে হয়। তাছাড়া বন্যার সময় সড়কে কোথাও কোমর পানি আবার কোথাও গলা পানি পর্যন্ত হয়ে যায়।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের গ্রামটি জেলা সদরের নিকটবর্তী হওয়ার পরও এখানে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। গ্রামে পাকা সড়ক নেই, বিদ্যুৎও নেই। ফলে শিক্ষার প্রসারে আমাদের এলাকা পিছিয়ে পড়ছে। যারা বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে তারাও কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। মাটির সড়কগুলো দ্রুত পাকা করণসহ এলাকা বিদ্যুতায়ন করার দাবি জানান মুজিবুর রহমান।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল খায়ের বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থা এতটাই নাজুক যে, অনেক ছাত্র-ছাত্রী সময় মতো বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। গ্রামে একটি মাত্র ফেরি নৌকা চলাচল করে। এবং সকলের বাড়িতে নৌকা থাকে না। প্রধান শিক্ষক বলেন, বছরের প্রায় ৬মাসই পানি-কাদা মাড়িয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসা-যাওয়া করে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন- আমি এই স্কুলে যোগদান করার পর থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে পরীক্ষার কোনো ফি নেই নি। আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে তাদের পরীক্ষার ফি’র টাকা বহন করে থাকি। প্রত্যন্ত অঞ্চল রাঙ্গামাটিয়া গ্রামের রাস্তা-ঘাটের সংস্কার ও গ্রামে বিদ্যুতায়ণসহ সকল অবকাঠামো উন্নয়নে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন এলাকাবাসী।