সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণবার্ষিকী ২২ শে শ্রাবণ। ঘন বর্ষার ¯্রােতধারা নিয়ে বড় ভালবাসায় যে তাঁর অবিনশ্বর গানের সৃষ্টি করেছেন সে বর্ষাতেই তিনি পৃথিবী ছেড়েছেন। সে এক আশ্চর্য সুন্দরের ইতিহাস! শুধু বর্ষা নয় ষড়ঋতু নিয়েও তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। আর সেসব গানে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের যাপিত জীবনের নানাবিধ দিক। সে কারণেই বাঙালির সুখে-দুখে তাঁর যাপিত জীবনের অধ্যায়ন ও তাঁর গান খুব বেশি প্রাসঙ্গিক।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য এই কবি ৭৫ বছর আগে ১৯৪১ সালের ৬ আগস্ট, বাংলা ১৩৪৮ সনের ২২ শ্রাবণ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির শ্যামল প্রাঙ্গণে পরলোকগমন করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ জন্ম-মৃত্যুর মাঝে তফাত দেখেছেন খুব সামান্যই। সৃষ্টিই যে এই নশ্বর জীবনকে অবিনশ্বরতা দেয়, সে কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন বলেই তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু দিয়ে যে প্রাণের মূল্য দিতে হয়/ সে প্রাণ অমৃতলোকে / মৃত্যুকে করে জয়।’
তিনিই আবার জীবনসায়াহ্নে লিখেছিলেন- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যখন ইহধাম ত্যাগ করেন সেদিন শোকার্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিগুরুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছিলেন, ‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপারে কোলে/ বাংলার কবি শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি তুমি চলে যাবে বলে/ শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে।’
৮০ বছর বয়সে চলে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ মৃত্যু দেহান্তর মাত্র। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক কিছুরই প্রথম ¯্রষ্টা তিনি। তিনি পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার শিল্প-সাহিত্যও পরিণত হয়েছে। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য নতুন রূপ লাভ করে। বাংলা গদ্যের আধুনিকায়নের পথিকৃৎ রবিঠাকুর ছোটগল্পেরও জনক। গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নতুন নতুন সুরে ও বিচিত্র গানের বাণীতে, অসাধারণ সব দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিসংলগ্ন গভীর জীবনবাদী চিন্তাজাগানিয়া নিবন্ধে, এমনকি চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ চিরনবীন-চির অমর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন দার্শনিকও। তার ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তা-চেতনা শুধু নিজের শান্তি বা নিজের আত্মার মুক্তির জন্য ধর্ম নয়। মানুষের কল্যাণের জন্য যে সাধনা তাই ছিল তার ধর্ম। তার দর্শন ছিল মানুষের মুক্তির দর্শন। মানবতাবাদী এই কবি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বমানবতায়। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেই দর্শনকে অন্বেষণ করেছেন তিনি। তার কবিতা, গান, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার লেখনী মানুষকে আজও সেই অন্বেষণের পথে, উপলব্ধির পথে আকর্ষণ করে। রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের মনমানসিকতা গঠনের, চেতনার উন্মেষের প্রধান অবলম্বন। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। এখনও প্রতিবছর রমনা বটমূলে রবীন্দ্রনাথের গানে গানে পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। আমাদের জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যেখানে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাই না। তার রচনাবলী আমাদের প্রেরণার শিখা হয়ে পথ দেখায়। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ‘সং অব অফারিং’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
তিনিই একমাত্র কবি, যিনি তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা (বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা)। জীবনের শেষ পর্যায়ে চিত্রকর হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। আশি বছরের জীবন সাধনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুকে একাকার করে তুলেছিলেন অজ¯্র অমরতার শাশ্বত বার্তায়।
সত্যি বলতে বাঙালির চেতনার রঙ ¯পষ্ট হয়েছে রবিঠাকুরের আলোয়। তাইতো তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। আজকে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতার বাণী এবং তার মতাদর্শ জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। রবীন্দ্রচর্চা তরুণ সমাজকে করে তুলতে পারে আরো মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী।
প্রসঙ্গত, ১২৬৮ সনের ২৫ বৈশাখ (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি একাধারের কবি, নাট্যকার, কথাশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, অভিনেতা, ছোট গল্পকার ও ভাষাবিদ। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খন্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।