বিশেষ প্রতিনিধি ::
১৯৭১ সনে বিজয় দিবসের প্রারম্ভে নির্মিত সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি জনআবেগ আর ভালোবাসার এক অনন্য স্থাপনা। স্বাধীনতার ৪৫ বছর ধরে শহরের ডিএস রোডের বাম পাশে ঐতিহ্যবাহী শহীদ মিনারটিতে আপামর জনতা জাতীয় দিবসগুলোতে শহীদদের শ্রদ্ধা-স্মরণের পাশাপাশি সকল অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্লাটফর্মে রূপান্তর করেছেন। সেই শহীদ মিনারটি অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য গত বছর একটি মহল এখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার চেষ্টা করলে জেলার প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের লোকজন রুখে দাঁড়ান।
ফলে সংশ্লিষ্টরা বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরেই আসেননি প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকসহ সুধীজন ঐতিহ্যের শহীদ মিনারের পেছনের অংশ আইন মন্ত্রণালয় থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার জনদাবির সঙ্গে বৈঠক করে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সেই উদ্যোগটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে জানেন না জেলার সুধীজন। সম্প্রতি সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠের উত্তর-পূর্ব কোণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নামে নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন সুধীজন, সাবেক ও বর্তমান জুবিলীয়ানরা। শহীদ মিনার সংস্কার-বাস্তবায়ন কমিটির নেতারাও এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না।
জানা গেছে, গত বছর একটি মহল শহীদ মিনারটি স্থানান্তর করতে উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এর প্রতিবাদে একাধিক কর্মসূচি মতবিনিময় এবং জনমত জরিপও চালায়। জনমত জরিপেও পুরনো শহীদ মিনারটি সংস্কার এবং বর্ধিতকরণের দাবি ওঠে। ওই সময় সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটিকে ‘পরিত্যাক্ত, অস্তিত্বহীন’ দেখিয়ে অন্যত্র সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে মুক্তিযোদ্ধা-জনতা অভিযোগ করেন। এ নিয়ে পরবর্তীতে মামলাও হয়।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে ১৪৪/২০১৪ স্বত্ত মোকদ্দমায় সুনামগঞ্জ সিনিয়র সহকারি জজ আদালত শহীদ মিনারের ভূমি তাদের দাবি করে মামলা দায়ের করেন। এর জবাবে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন জানায়, নালিশা ভূমির ২নং লটে ঐতিহাসিক শহীদ মিনার রয়েছে। কিন্তু সুনামগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের মধ্যে এই মূল্যবান ভূমি থাকায় ২০১৪ সনের ১ ডিসেম্বরে এক জবাবে শহীদ মিনারের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। একইভাবে সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয়ও ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর পৃথক জবাবে তারা শহীদ মিনারের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে।
জানা গেছে, গত বছরের ৩ এপ্রিল সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদে এ নিয়ে এক জরুরিসভা হয়। ওই সভায় জেলার তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীরা ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংস্কার ও একইস্থানে বর্ধিতকরণের আহ্বান জানান। ওই সভায় যারা অন্যত্র শহীদ মিনার সংস্কারের ফন্দি আঁটছিলেন তারা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে চুপসে যান। সভায় শহীদ মিনার নির্ধারিত স্থানে অবিকল কাঠামোয় পুনঃনির্মাণ ও স্থান বর্ধিত করার দাবিতে জেলার সকল পর্যায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ বলে জানানো হয়। এদিকে একই দাবিতে গত বছরের ৪ এপ্রিল সুনামগঞ্জ পৌরসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিককে নিয়ে সংস্কৃতিকর্মী, নাগরিক সমাজ ও মুক্তিযোদ্ধারা বৈঠক করে শহীদ বর্ধিতকরণে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যে ভূমি জটিলতা রয়েছে তা দূর করে শহীদ মিনার সম্প্রসারণে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন।
অন্যদিকে প্রশাসনিকভাবে রেকর্ডপত্রে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অস্তিত্ব অস্বীকারের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের নেতা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সদস্যসচিব মালেক হুসেন পীর পক্ষভুক্তির আবেদন করেন। মালেক হুসেন পীর গত বছরের ৬ জুলাই সুনামগঞ্জ সহকারি সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয়ের নোটিশ পেয়ে শহীদ মিনারের পক্ষে জরুরি কাগজপত্র উপস্থাপন করেন। এভাবে ঐতিহ্যের শহীদ মিনারটি রক্ষায় আন্দোলন করছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি ঐতিহ্যের শহীদ মিনারটি সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায় বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তারা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আমরা চাই, তবে আমাদের খেলার মাঠ সংকুচিত করে নয়। কারণ আমাদের ক্যাম্পাসেই আরেকটি পৃথক শহীদ মিনার রয়েছে।
বর্তমান ও সাবেক জুবিলয়ানরা খেলার মাঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থানান্তরের প্রতিবাদে অনলাইন-অফলাইনেও কর্মসূচি পালন করছেন। বর্তমান ছাত্ররা গতকাল বুধবার এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে। সাবেক জুবিলয়ানরা আগামী রোববারে পৃথক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের সিনিয়র সদস্য, আইনজীবী ও লেখক কল্লোল তালুকদার চপল বলেন, আমরা পূর্বেও বলেছি আমাদের ঐতিহ্যের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি সংস্কার ও বর্ধিত করা হোক। এখন আমাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়েছে জুবিলী স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তারা নিজেদের খেলার মাঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চায়না। তিনি বলেন, আমরা জানতে চাই আইন মন্ত্রণালয় থেকে শহীদ মিনারের ভূমি জটিলতা নিরসনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার সর্বশেষ আপডেট কি। যারা স্কুলমাঠ সংকুচিত করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন আমরা তাদের এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।