বছর ঘুরে ফিরে আসে ঈদ। প্রত্যেক মানুষের মনে ঈদের আনন্দের কোনো শেষ নেই। ঈদ বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আবার দুই ধরনেরÑ ছোটলোকের ঈদ ও বড়লোকের ঈদ। এ জন্য এই কথাটা বললাম ঈদে একজন বড়লোকের মেয়ে যে দামী কামিজ বা শাড়ি পরে সেটার দাম অনেক টাকা। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে যদি পাঁচজন সদস্য থাকে এই পাঁচজন সদস্যের জন্য যত টাকার পোশাক প্রয়োজন তত টাকার পোশাক একজন বড়লোকের মেয়ে প্রত্যেক ঈদেই পরিধান করে। গার্মেন্টসের যে মেয়েটি বড়লোকের মেয়েদের জন্য দামি দামি শাড়ি, কামিজ তৈরি করে গার্মেন্টসের সেই মেয়েটি আবার সেই দামি দামি শাড়ি, কামিজ পরতে পারে না। গার্মেন্টসে কর্মরত মেয়েটির দু’টির বেশি পোশাক নেই, সেই পোশাকও আবার মেয়েটি কিনে ফুটপাত থেকে। বর্তমানে একজন শ্রমিকের যে বেতন, সেই বেতন থেকে দুই মণের বেশি চাল পাওয়া যায় না। এই বেতন দিয়ে একজন শ্রমিকের পরিবার চলে না। অনেক সময় এই শ্রমিকদের না খেয়ে থাকতে হয়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় শ্রমিকদের ছেলে-মেয়ের পাকস্থলি জ্বলে। যারা সমাজ ও সভ্যতার কারিগর, যারা টিকিয়ে রাখছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্থনীতি তারা আজ ভাত খেতে পারে না। এই শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য বলেছিলেনÑ “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি।” আমাদের দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ খেটে খাওয়া কৃষক দিনমজুর আর পাঁচ ভাগ মানুষ ধনী। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের রক্ত শোষণ করে যারা সম্পদের পাহাড় তৈরি করে। একজন কৃষক এক মণ ধান বিক্রি করে আজ তার বউয়ের জন্য একটি শাড়ি কিনতে পারছে না এই সমাজে। ধনতান্ত্রিক এই সমাজে ঈদ ধনীদের জন্য আনন্দ, গরিবের জন্য অভিশাপ।
আমাদের সুনামগঞ্জ জেলার দিকে যদি তাকাই তবে দেখা যায়, এই জেলার অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। এ বছর সারা জেলার প্রত্যেক হাওর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সমস্ত কৃষক-কৃষাণীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। আষাঢ় মাস আসলে একজন কৃষক-কৃষাণী ধান বিক্রি করে উপাজির্ত টাকা দিয়ে তাদের মেয়ের বিয়ে দেন। ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী একজন মেয়েকে বিয়ে দিতে হলে তার সাথে অনেক কিছু দিতে হয়। আসবাবপত্র বা যৌতুক না দিতে পারলে মেয়েকে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। হাওরে পানি ঢোকার ফলে হাজার হাজার কৃষকের স্বপ্ন আজ ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। যাদের ঘরে এক মণ ধান পর্যন্ত নেই তাদের আবার কিসের ঈদ।
সমাজের মধ্যে যে শোষণ আমরা দেখতে পাই অর্থাৎ মানুষের রক্ত ও শ্রমকে যে শোষণ করে তার নাম- ‘পুঁজি’। পুঁজি ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্য দিয়ে মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে। মনীষী কার্ল মার্কস বলেছেনÑ “ব্যক্তিগত সম্পত্তি আমাদের এতোটাই বেকুব এই একপেশে করছে যে, আমরা যখন একটা বিষয় প্রাপ্ত হই তখন তা কেবলই আমাদের অথবা তা আমাদের জন্য পুঁজি হিসেবে অস্তিত্বশীল। অথবা তখন এটা সরাসরি ভোগদখলকৃত, খেয়ে নেয়া, পান করে নেয়া, পরিধানকৃত বাসকৃত সংক্ষেপে তা আমাদের দ্বারা ব্যবহৃত। যদিও ব্যক্তি সম্পত্তি নিজেই আবার এই সব দখলের সরাসরি উপলব্ধিকে ধারণা করে কেবল জীবনধারণের উপায় হিসেবে। যে জীবনে তারা উপায় হিসেবে সেবা করে তা হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির জীবন-শ্রম এবং পুঁজিতে রূপান্তর। সকল শারীরিক এবং মানবিক ইন্দ্রিয় সমূহের স্থানে তাই চলে এসেছে এই সকল ইন্দ্রিয়ের পুরোদস্তুর বিচ্ছিন্নতা, অধিকারবোধের সংবেদন। মানবসত্তা যাতে তার অন্তর্গত সম্পদ বাইরের জগতে তুলে আনতে পারে তার জন্য তাকে চরম দারিদ্র্যে পর্যবসিত করা হয়।”
মনীষী কার্ল মার্কস এখানে বুঝাতে চেয়েছেন মানুষের জীবন দাসের চেয়েও নিকৃষ্ট। সমাজের শোষণটা কোনো অলৌকিক বিষয় নয়, মানুষই মানুষকে শোষণ করছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই মানুষের জীবনটা ছিল দাসের জীবন পাকিস্তান আমলেও ঠিক একইভাবে মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধটা ছিল একটা অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, তাই মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালে একটি সংবিধান রচিত হয় চারটি মূলনীতি নিয়ে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল চার মূলনীতি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ৭২-এর সংবিধানকে ভেঙে খান খান করা হয়। হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির জীবনের দ্রোহ, সংগ্রামের ভেতর দিয়ে একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি স্বপ্ন নিয়ে। সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপ্ন বিনষ্ট করার মধ্যদিয়ে বিগত ৪৫ বছর ধরে শাসকগোষ্ঠীরা পালাক্রমে দেশ পরিচালনায় চলমান বাস্তবতার নানা ব্যাখ্যায় ও কৃতিত্বের দাবিতে শাসন-শোষণ নির্যাতনের ভেতর দিয়ে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানে এখন যদি সমাজতন্ত্র বহাল থাকতো তাহলে মানুষের জীবন হতো প্রকৃত জীবন, মানুষকে দাসের মতো দেখা হতো না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ফলে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের অর্থ উপার্জনের পথ প্রশস্ত হয়ে যেতো। ব্যক্তির মালিকানা ও পুঁজির শোষণ বিদায় নিলে কৃষক শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষেরা স্বস্তিতে ঈদ করতে পারতো। বাংলার ঘরে ঘরে কৃষাণ-কৃষাণীর মুখে হাসি ফুটতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই আমাদের রাষ্ট্রের মুক্তবাজার অর্থনীতি বিকশিত হয়ে যায়। লুটেরা অর্থনীতির ফলে সমাজের পাঁচভাগ মানুষ রাতারাতি ধনী হয়ে যায়। কিছুদিন আগে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলে উঠলেন কৃষকদের ভ্যাট দিতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে কোটিকোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেলে তিনি বলে উঠেন এতো কোটি টাকা কোনো টাকা হলো। তবে আমরা যদি দেখি রিজার্ভ ব্যাংক চুরি ৮০০ কোটি টাকা ২০১৬, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী ১৫শত কোটি টাকা ২০১০, হলমার্ক কেলেঙ্কারী ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ২০১২, বেসিক ব্যাংক ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ২০১২-১৩, ডেসটিনি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা ২০০৬-১২। বিগত সাত বছরে এসব ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা লোপাট বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই হলো আমাদের রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চরিত্র। মানুষের জীবনকে দাসত্বের মধ্যে রেখে নানা কৌশলে শোষণ করে যাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র। বিশ্ব পুঁজিবাদ সা¤্রাজ্যবাদের শক্তির প্রধান উৎস প্রায় চার দশক ধরে এদেশ পরিচালিত হচ্ছে সা¤্রাজ্যবাদনির্ভর মুক্তবাজার অর্থনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে। বিদেশি পুঁজির কমিশন এজেন্ট হিসেবে অনুপার্জিত আয়ের পথ ধরে দেশের মেহনতি মানুষদের অতিশোষণ সর্বোপরি ঘুষ দুর্নীতি চোরাচালানি ইত্যাদি কাজ কর্মের মাধ্যমেই এই পুঁজি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া মহাকলেবরে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের সর্বনাশ অব্যাহত থাকলেও মুষ্ঠিমেয় শতকরা ১ জন বিশেষগোষ্ঠীর লোক আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। কলা গাছ থেকে বটগাছ হয়ে উঠছে।
দীর্ঘ আলোচনার পর মূল বাধাটা হলো পুঁজিবাদ বা পুঁজির শোষণ। যতদিন সমাজ ও রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থা চলতে থাকবে ততদিন মানুষের মুক্তি অসম্ভব আর মানুষের মুক্তি ব্যতীত মানুষের ঈদ কখনো আসবে না। সব মানুষের জন্য ঈদের আনন্দ রচনা করতে হলে পুঁজির শোষণ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আর সেই জন্য আমাদেরকে সাম্যবাদের যে লড়াই, ন্যায়ের যে লড়াই সেটা চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন বিপ্লবী চে-গুয়েভারা বলেছিলেনÑ “বাস্তববাদী হও, অসম্ভবকে দাবি কর।”
[লেখক : সদস্য, জাতীয় পরিষদ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]