গাঙের সফেদ জলে নিজের মুখ দেখে আজিরন। মুখটি কেমন ফ্যাকাশে, করুণ চাহনি। নিজের চেহারা দেখে মায়া হয় তার। আজিরন বলে ডাক দেয় নিজেরে। বোবা কান্নায় হু হু করে উঠে বুক। দু’চোখের অশ্রু বেয়ে পড়ে গাঙের জলে। বুকের ভেতরটা চেঁচিয়ে ওঠে-আজিরন- আজিরন…! আজিরন নির্বাক অপলক তাকিয়ে জলের সাথে কথা বলে; ওই সর্বনাশা পানি- ধান নিয়ে গেলি কেন? আমারে নিতে পারলি না? এবার আমারেও নিয়া যা। আজিরন কাঁখের কলসি ভাসিয়ে দেয় গাঙের জলে। কষ্টে তার ইচ্ছে করে জলে ঝাপ দিতে; “বু..বু এই বু” মজিরন পিছন থেকে হাঁক ছাড়ে। সেই কখন এলি কলসি নিয়ে…! আজিরন সম্বিত ফিরে পায়, মজিরনকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে-আমার সব শেষ হয়ে গেলরে মজিরন। মজিরনও চোখের জল ধরে রাখতে পারে না।
আজিরনের বাবা মফিজ আলী বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন পাশের গ্রামের ছবুরের সাথে। কথা ছিল বৈশাখী তোলে খুব ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবেন। এবছর পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে বোরো ফসল। তাই ভেস্তে গেছে স্বপ্ন। কৃষকের চোখের জলে ভাসে বৈশাখ। স্ত্রী ছায়ারুন, দুই মেয়ে আজিরন আর মজিরনকে নিয়ে মফিজ আলীর সংসার। কোন ছেলে সন্তান না থাকায় বৃদ্ধ বয়সেও সংসারের ঘানি টানতে হয়। নিজের কোন জমি-জমা না থাকায় অন্যের জমি বর্গাচাষ করে চলে সংসার। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে বোরো জমি চাষ করেছিল। প্রতি বৈশাখে যে ধান গোলায় উঠে তাই দিয়ে মোটামুটি চলে সংসার। ধান বিক্রি করেই বাজার সওদা। ধান বিক্রি থেকেই বউ মেয়েদের জন্য একটু জামা-কাপড়। সবুর মফিজ আলীকে লোক মারফত খবর পাঠিয়ে জানিয়েছে সে আর বিয়ে করবে না এবং কাজের সন্ধানে আজই শহরে চলে যাচ্ছে। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার খবর শোনে আজিরন পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। ওদিকে বড় মেয়ের কথা চিন্তা করতে করতে বাবা মফিজ আলী ও মা ছায়ারুন নিরেট পাথর হয়ে গেছে। সমস্ত পরিবারে চলছে বিলাপধ্বনী। ঘরে কোন সদাইপাতি নেই। চুলায় আগুন জ্বলে না। সবাই যেন বুকে পাথর চেপে আছে। ক্ষুদার জ্বালা বড় পীড়া দেয়। কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসে না। কেইবা আসবে, সবার একই দশা! হাওরপাড়ের কৃষকের ঘরে ঘরে শুধু হাহাকার। ষাটোর্ধ্ব টাকওয়ালা বেপারী আজ এসে আজিরনের বাবাকে বলে গেছে- পাঁচ হাজার টাকা নিছিলা, বৈশাখ মাসে ধান দিবা বলে; এখন তো ধান নাই তয় আমার টাকা দিয়া দাও। আজিরনের বাবা মফিজ আলী বেপারীর হাত ধরে কাকুতি মিনতি করে- আপনার টাকা কেমনে দিব। ধান নাই, ঘরে খাওন নাই, গুড়- চিড়া খাইয়া কোন মতে বেচেঁ আছি।
ব্যাপারী তখন বলেছিল, টাকা দিতে পারবা না তা ঘরে তো তোমার বিয়ার যোগ্য দুইডা যুবতী মাইয়্যা আছে, বড়ডারে আমার কাছে বিয়া দিয়া দেও। আমি তোমার টাকা মাফ কইরা দিমু। আর তোমার মাইয়্যার খাওন দাওনের অভাব হইবো না। তুমিও সব সময় সাহায্য পাইবা।
ঘরের দাওয়ায় বসে মফিজ আলীর সাথে ব্যাপারী যখন এসব কথা বলছিল, ভেতর ঘর থেকে আজিরন সব কথা শূনতে পায়। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। বাচঁতে আর ইচ্ছে করে না। ঘর থেকে কলসি কাখে নিয়ে গাঙে যায়। জলের আয়নায় দেখে নিজের মুখ।
পশ্চিম আকাশে সূর্য্য অস্তমিত হচ্ছে। দিনের আলো একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে রাতের অন্ধকার। পানি না নিয়েই বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরে আজিরন। অনুসন্ধানী চোখে মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জরিপ করে। তাদের অসহায়ত্ব স্পষ্ট ধরা পড়ে। আজিরনের বুকটা ভেঙ্গে যায়। কারো সাথে কোন কথা বলেনা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল তাকায়। বাবা-মায়ের উপর বোঝা মনে হয় নিজেকে।
গভীর রাতে আজিরন দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, ঝিঁঝিঁ’র ডাক বিকট লাগে। কুপির আগুনে দেখে মজিরনের মুখ!! তার মাথার কাছে হাত বাড়ায়, হাত কেঁপে উঠে, বুকে ধরফড়ানি। বিছানা ছেড়ে জামাকাপড় পুটলিতে বেঁধে হাতে নেয় আজিরন। ভাঙ্গা বেড়ার ফুটো দিয়ে মা’বাবার মুখ এক নজর দেখে নেয়। পাহাড়ি ঢলের মতো হুড়মুড়িয়ে জল আসে চোখে। দরোজার কপাটে হাত রেখে ঘাড় ফিরিয়ে আরেকবার দেখে নেয় মজিরনকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুটলি হাতে শহরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়, রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় আজিরনের মুখ!