সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক গণভোটে ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে ৪১ বছরের বন্ধন ছেঁড়ার পক্ষে রায় এসেছে। বৃহ¯পতিবার অনুষ্ঠিত এই ভোটের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগেই বিচ্ছেদপন্থিদের জয় ¯পষ্ট হয়ে যায়।
বিবিসি বলেছে, ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট পড়েছে ৫২ শতাংশ, আর থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন সাড়ে ৪ কোটি ভোটারের ৪৮ শতাংশ।
রয়টার্স, গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, স্কাই নিউজের প্রতিবেদনেও একই ধরনের ফলাফল জানিয়ে বলা হয়, ভোটে যুক্তরাজ্যে দ্বিধাবিভক্তি ¯পষ্ট হয়ে গেছে।
গত কিছুদিন ধরে বিশ্ববাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা এই ভোটের ফল দেখে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। টলমলে হয়ে উঠেছে পুঁজিবাজারও।
ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির গণভোটের রায় ইইউর বাকি ২৭ সদস্য দেশের রাষ্ট্রনেতার কপালেও ভাঁজ ফেলেছে।
অভিবাসী ও গ্রিসকে উদ্ধারের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নিজ নিজ দেশেও ইইউ ছাড়ার জিগির উঠতে পারে বলে শঙ্কা করছেন অন্য দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়করা।
গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের ভবিষ্যতেও অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছিল গণভোটের এই ফল।
দাবি ওঠার প্রেক্ষাপটে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে গণভোটের রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে ইইউ ছাড়ার পক্ষে জোর প্রচারকারী ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির নেতা মাইকেল ফারাজ বলছেন, জনগণ ‘স্বাধীনতার’ পক্ষে রায় দিয়েছে।
৪১ বছর আগে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) যোগ দেওয়ার প্রশ্নে গণভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যবাসী। তাতে ৬৭ শতাংশ ইইসির পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ওই ইইসিই পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউতে রূপ নেয়।
২৮ জাতির জোটের সঙ্গে চার দশকের স¤পর্ক ছিন্ন করে নতুন পথে হাঁটার প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের এই গণভোটকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘ব্রেক্সিট’।
গণভোটের ফল অনুসারে কাজ হলে যুক্তরাজ্যই হবে প্রথম দেশ, যারা ইইউ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় জোট থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে কিছু ডানপন্থি রাজনীতিবিদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালে গঠিত হয় ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি। দলটি ২০১৩ সালে স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে সাফল্য পায় এবং প্রতিনিধিত্বের বিচারে যুক্তরাজ্যের চতুর্থ শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।
ইনডিপেনডেন্স পার্টির এই উত্থান কনজারভেটিভ পার্টির জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে অনেকটা চাপের মুখেই ইইউ প্রশ্নে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন কনজারভেটিভ নেতা ক্যামেরন, সেই ভোটের ফলই এখন তার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্যামেরন ইইউর পক্ষে অবস্থান জানালেও তার দলের একটি বড় অংশ বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
তবে গণভোটের ফল ঘোষণার পরপরই ইইউর সঙ্গে বিচ্ছেদ হচ্ছে না যুক্তরাজ্যের। পুরো প্রক্রিয়া ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে স¤পন্ন হবে না বলে জানিয়েছে বিবিসি।
লিসবন চুক্তির আর্টিকেল-ফিফটিতে স্বাক্ষরের পরও অন্তত দুই বছর ‘বিচ্ছেদ’ সংক্রান্ত আলোচনা চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই আলোচনাতেই ‘যুক্তরাজ্য কোন প্রক্রিয়ায় ইইউ ছাড়বে’ তা ঠিক হবে।
গণভোটের রায় ঘোষণার পরপরই ক্যামেরন ওই আর্টিকেলে স্বাক্ষর করবেন বলে আগে প্রতিশ্রুতি দিলেও ‘বিচ্ছেদপন্থী’দের শীর্ষ নেতা বরিস জনসন ও মাইকেল গোভ এ বিষয়ে ‘তাড়াহুড়ো’ না করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান চানিয়েছেন।
ইইউ’র নিয়ম অনুযায়ী, আর্টিকেল-ফিফটি চালু করা দেশ এরপর আবারও সংস্থায় ফিরতে চাইলে সদস্য সব রাষ্ট্রের সমর্থন লাগবে।
ভোটের আগেই ধারণা করা হয়েছিল যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি, ফলাফলেও তার প্রতিফলনই ঘটেছে।
ভোট মানচিত্রে দেখা যায়, গোটা যুক্তরাজ্যের উত্তর অংশ ইইউতে থাকার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, বিপরীতে দেশের দক্ষিণের প্রায় পুরো অংশ এই জোট ছাড়ার পক্ষে।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে বিচ্ছেদপন্থিরা জয়ী হলেও স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। তবে সবখানেই ব্যবধান খুবই কম।
ইংল্যান্ডে ১ কোটি ৫২ লাখ ইইউ ছাড়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। বিপরীতে থাকার পক্ষে ভোট পড়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ। এখানে ভোটের হার ৭৩ শতাংশ।
ওয়েলসেও রায় গেছে ইইউ ছাড়ার পক্ষে। মোট ভোটারের ৭২ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট সাড়ে ৮ লাখ, থাকার পক্ষে পৌনে ৮ লাখ।
স্কটল্যান্ডে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন সাড়ে ১৬ লাখ, ছাড়ার পক্ষে ১০ লাখ। এখানে ভোটের হার ৬৭ শতাংশ।
একইভাবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাড়ে ৪ লাখ ভোটার ইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। সাড়ে ৩ লাখ ভোট দিয়েছেন ছাড়ার পক্ষে। এখানে ৬৩ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন।
রাজধানী লন্ডনের বেশিরভাগ ভোটার ইইউতে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এখানে ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে থাকার পক্ষে, বাকি ৪০ শতাংশ বিপক্ষে।
মোট ভোটের হার ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যালটে ‘লিভ’ অর্থাৎ ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১ কোটি ৭৪ লাখ ১০ হাজার ৭৪২ জন। ‘রিমেইন’ অর্থাৎ থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১ কোটি ৬১ লাখ ৪১ হাজার ২৪১ জন।
গণভোটে ভোটের হার গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের চেয়েও বেশি বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
বৃহ¯পতিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৯৯ হাজার ৫৩৭ ভোটার ৪০ হাজারটি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেন। এরপর ব্যালট বাক্সগুলো ৩৮২টি কেন্দ্রে নিয়ে শুরু হয় গণনা।
১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে একযোগে ফল ঘোষণা শুরু হয়। সব ফল যোগ করে ম্যানচেস্টার টাউন হল থেকে পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা হয়।
বিরোধী লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলী ও টিউলিপ সিদ্দিকও ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিতে আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন।