সুভহা রহমান ::
জয়া তাকিয়ে আছে অপলক। ছেলেটা একহারা লম্বা। একমুখ দাড়িগোঁফ। এলোমেলো চুল। চেহারায় সেরকম কোন বিশেষত্ব নেই। শুধু চশমার আড়ালে একজোড়া মায়াবী স্বচ্ছ চোখ। জয়া এবার আস্তে করে বল্ল, তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, সিট টা আপনার? ছেলেটি ঘাড় বেকিয়ে বল্ল, হু। আমার। কারণ, টিকিটেলিখা নাম্বার তাই বলে। জয়া কিছুটা অসহায় বোধ করছে। এই প্রথম একা ময়মনসিংহ যাচ্ছে। মামা টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দিয়ে বল্ল, ‘জানালার পাশে বসে পড়। এটাই তোর সিট।’ কি বিপদ, কোথা থেকে এই ঢ্যাঙা মতন ছেলেটা এসে বলছে এটা তার সিট। জয়া, জানালার ধার ছাড়া বসতে পারে না। এর আগে যতবার গেছে জানালার সিট ওর জন্য বুকড। জয়া রিতিমত ঘামছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে টিকিট বের করে দেখল। ছেলেটা ঠিক। মামা ৪৪টি টিকিট বলেছে বাংলায়। এইটিএইট কে সে চুয়াল্লিশ ভেবে ভুল করেছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই এই বিপত্তি। ‘এই যে ম্যাম কিছু তো করবেন। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো!’ অধৈর্য্য কণ্ঠ। জয়া সত্যি অসহায় বোধ করছে কিছুটা অপমানিত। জয়া দেখতে বেশ মায়াকাড়া। এরকম একটা মেয়ের সাথে কোঠর হয়ে কথা বলা ছেলের সংখ্যা কম। এবার জয়া বললো, দেখুন আমি তো ইচ্ছা করে ভুল করিনি। আর, একা যাচ্ছি। ট্রেনও ছেড়ে দিয়েছে। আপনি যদি আমার সিটে গিয়ে বসেন উপকৃত হবো। শিহাব ভীষণ বিরক্ত ছিল। এইবার মেয়েটির দিকে তাকালো। তাকিয়ে রীতিমত ধাক্কা খেলো। মেয়েটিকে সুন্দরী, মিষ্টি চেহারা এরকম উপমা দেয়া যাবে না। প্রথম যেই শব্দটা মাথায় এলো সেটা, “মায়াবতী”। এইপ্রথম কোন ফর্সা মায়াবতীর দেখা পেলো। মায়াবতীরা সাধারণত কিছুটা শ্যাম বর্ণের হয়। মনে মনে নিজের কাব্য ব্যাখ্যায় পুলকিত হলো শিহাব। পরের আধঘণ্টা জয়া শক্ত হয়ে বসে রইল। কারণ দু’জনের টিকিট নিয়ে ছেলেটা “ম্যানেজ করে আসি” বলে, কোথায় উধাও হলো। ছেলেটি যদি ভাওতা দিয়ে চলে গিয়ে থাকে। জয়া জানে না, টিকেট দেখতে আসা টিকেট চেকার কাহিনী টা বিশ্বাস করবে কিনা। জয়াকে ভারমুক্ত করে ঠিক আধঘণ্টা পর শিহাব ফিরে এলো। এসেই বললো, আমি শিহাব আপনার পাশে বসলে তো আপত্তি নেই তো? জয়া বললো- জ্বী না। শুধু জানালার কাছের সিটটা আমাকে দিলে চলবে। শিহাব আর কিছু বললো না। কাঁধে ঝোলানো কালো হ্যান্ডি ব্যাগ থেকে মৈত্রি দেবীর ‘ন’ হন্যতে বই বের করে পড়তে শুরু করলো। জয়া ভীষণ অবাক। আজকাল খুব কম ছেলে মেয়েরা এরকম বই পড়ে। ডিজিটাল যুগে অনলাইন তাদের একমাত্র বিনোদন। জয়া ব্যতিক্রম। তাই ব্যতিক্রম শিহাবকে দেখে বেশ কৌতুহল হলো। জয়া বাইরে তাকালো। ট্রেনের ছুটে চলার সাথে সাথে দ্রুত দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। এখনকার যুগ টাও তাই, খুব দ্রুত সব বদলে যায়। দ্রুতগামী ট্রেনের মতন। জয়া কি কিছুটা সেকেলে! লিয়ানা দের যুগে সুচিত্রা ওকে বেশি টানে। অদ্ভুত। জয়া পাশে বসা শিহাবের দিকে আড়চোখে তাকালো। ছেলেটার মনোযোগ গভীর। নিবিষ্টমনে বই পড়ছে। হঠাৎ মনে হলো এই ছেলেটা তার চেনা। খুব আপন কেউ, খুব কাছের। অদ্ভুত এক অনুভুতি হলো জয়ার। মুহূর্তে শিহাবকে দেখে নিলো আবার। ভাগ্যিস বিধাতা মনের ভাষা পড়ার কোন নিয়ম রাখেননি। জয়া আবার বাইরে তাকালো। মেঘ ও আলোর নাচন সামনের সবুজ দিগন্তে। ‘আপনি সবুজ শাড়ি পড়েছেন কখনো?’ হঠাৎ প্রশ্নে চমকিত জয়া। শিহাব তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে আছে। সরল প্রশ্ন, সরল চোখ। জয়া বললো, না। কেন বলুন তো? শিহাব বললো- ‘এই কথাটা এই মুহূর্তে মনে হলো। তাই জিজ্ঞেস করেছি। আপনাকে দেখে মনে হল কেন? সেটাও ভাবছি।’ চার ঘণ্টার জার্নিতে আর বিশেষ কোন কথা হয়নি। ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশনে থামলো, এখানে প্রচুর ভিড় হয়। ঢাকা কাছে। প্রতিদিন আসা যাওয়া লোকজনের, বিভিন্ন কাজের সুবাদে। জয়ার সামনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের দু’জন ছাত্র, কথা শুনে মনে হচ্ছে। জয়া বুঝতে পারছে না, এই ভিড়ের ভিতর সে নামতে পারবে কি-না। এখানে দশ মিনিটের বেশি ট্রেন থামে না। সে চকিতে শিহাবকে দেখল। ওর কাছ থেকে আর কোন সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে ন, হাতে বই নিয়ে উঠে দাঁড়াল শিহাব। জয়াকে কিছু না বলেই জয়ার ব্যাগ হাতে নিলো। বললো- ‘আমার পিছন পিছন আসেন। আমি সামনে ভীড় ঠেলে এগুই।’ জয়া বাধ্য মেয়ের মতন কথা মানল। না মেনে উপায় নেই। প্রচুর ভীড়। যারা ঢাকা-ময়মনসিংহ যাতায়াত করে, তারা সবাই জানে এর ভোগান্তি। ট্রেনের দড়জার কাছে পৌঁছাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। শিহাব পিছন ফিরে জয়াকে দেখল। তারপর বললো- আমার হাতটা ধরেন, তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাই। যে জয়া পরিচিত ছেলেদের এড়িয়ে চলে, সে আজ পরম নির্ভরতায় স¤পূর্ণ অপরিচিত একজনের হাত ধরল অবলীলায়। জয়ার আবার সেই অদ্ভুত অনুভূতি ফিরে এলো। মনে হলো এই ছেলেটা ওর খুব, চেনা কেউ। স্টেশনের বাইরে এসে শিহাব বললো- ‘বইটা একটু ধরেন। আমি আপনাকে রিক্সা করে দেই। কোথায় যাবেন? নাকি কেউ নিতে আসবে?’ জয়াকে ওর চাচা নিতে আসার কথা। সেরকমই কথা হয়েছে। কিন্তু জয়া শিহাবকে কিছু বললো না, শুধু বললো- রিক্সা করে দেন। আমি কলেজ রোড যাব। দুপুরবেলার তপ্ত রোদ, শিহাব কিছুটা এগিয়ে গেলো রিক্সার খোঁজে। জয়া এই ফাঁকে শিহাবের বইটার পাতা উল্টাল। যদিও সংকোচ হচ্ছিল। প্রথম পাতায় নীল কালি দিয়ে খুব সুন্দর হাতের লেখাÑ “সবুজ মায়াবতীর খোঁজে আমি দিশেহারা।” শিহাব, ১১/১ গ্রীণকর্নার।
কিছুক্ষণ পর শিহাব সামনে এসে বললো- ‘আপনি যান, আমি আপনার উলটা দিকে যাবো। ভালো থাকবেন। তারপর মাথা নিচু করে বললোÑ ‘আর দেখা হবে না হয়তো। তবু যেনো দেখা হয় মনে প্রাণে চাই, আপনি যেন সবুজ শাড়িতে থাকেন।’ জয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। শিহাব এই মায়াবতীর সামনে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। মেয়েটার দিকে তাকালেই কেমন ঝিমঝিম একটা ভাব হয়। মনে হয় তার স্বপ্নে দেখা সেই সবুজ মায়াবতী। শিহাব দ্রুত লম্বা পা ফেলে স্টেশনের ভীড়ে হারিয়ে যায়। কারণবিহীন কারণে জয়ার চোখ ঝাপসা হলো। অজানা কারণে কিছু অপরিচিত মানুষ, খুব অল্পতে হৃদয় আদ্র করে চলে যায়। শিহাবের ঠিক করে দেয়া রিক্সায় উঠল জয়া। সেলফোন বের করে চাচাকে ফোন দিয়ে বললো- ‘আসতে হবে না। ওই প্রান্তে চাচা কি বললো- জয়ার কানে কিছুই ঢুকল না। জয়া শুধু ভাবছে, খুব তাড়াতাড়ি ও ঢাকায় ফিরে যাবে। তারপর সবুজ শাড়ি পড়বে। ওর ঝাপসা হওয়া চোখে, মৈত্রি দেবীর বই এর প্রথম পাতায় লিখা ঠিকানাটা মনের খুব গভীরে গেঁথে আছে।