স্টাফ রিপোর্টার ::
মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক রূপে বিবেচিত দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উজানিগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন গোরস্থানটি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইতিহাসবিদদের মতে এখানে মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তিন যোদ্ধা পাশাপাশি শুয়ে আছেন। বিরল এই কবরস্থানটি মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রতিনিধিত্ব করছে। সম্প্রতি একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এই কবরস্থানে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের এক যোদ্ধার কবরের অস্তিত্ব স্বীকার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে গতকাল বুধবার সরকারিভাবে এখানে এক যোদ্ধার নামে নামফলক লাগানো থেকে বিরত থাকে মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সনের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত হওয়ার আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আহসানমারা (হালে শহীদ তালেব সেতু) এলাকায় প্রাণ হারান মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তালেব আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা কৃপেন্দ্র দাস এবং নাম না জানা অন্য ধর্মের আরেক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তদিবসের পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা-জনতা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তিন শহীদের লাশ নদী থেকে উদ্ধার করে জয়কলস উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি কবরস্থানে সমাহিত করেন। এরপর থেকেই বিরল এই কবরস্থানটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে তিন শহীদের নামে সরকারিভাবে এই কবরস্থানে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। নাম জানা দুই যোদ্ধা এবং নাম না জানা আরেক যোদ্ধাকে নিয়ে সহযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে লেখালেখি করেছেন। এই ঘটনাটি বই পুস্তকেও স্থান পেয়েছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি সিলেটে একটি অনুষ্ঠানে এই বিরল কবরস্থানটি সংরক্ষণের জন্য বিশিষ্ট সাংবাদিক আল আজাদ শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদকে অনুরোধ জানান। তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর কবির আহাম্মদকে গোরস্থানটি সংরক্ষণ এবং নামফলক লাগানোর নির্দেশনা দেন। এর ফলে উপ-পরিচালক এলাকায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে কবরস্থানটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। তিন যোদ্ধার নামে একটি ফলকও তৈরি করা হয়। তবে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিদ্যালয়ে ফলক লাগানোর আগে বৈঠক করতে এসে জানতে পারেন কয়েকজন ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক কারণে এই গোরস্থানে অন্য দুই যোদ্ধার লাশ অস্বীকার করে একজনের কথা স্বীকার করছে। তারা প্রভাব বিস্তার করে একজনের নামেই ফলক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। বৈঠকে কয়েকজন বাধা দিলে তাদের প্রভাবের কাছে চুপসে যান তারা। জানা গেছে, ওই সিদ্ধান্তের আলোকে গতকাল বুধবার অন্য দুই যোদ্ধাকে অস্বীকার করে ফলক নির্মাণের দিন ধার্য্য করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগে সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের নেতা ওবায়দুর রহমান কুবাদ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও মাধ্যমিক অধিদপ্তরের ডিজিকে ফলক নির্মাণ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান। সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাংবাদিক শামস শামীমও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপপরিচালককে প্রতিষ্ঠিত সত্যটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে একজনের নামে ফলক নির্মাণ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান। একইভাবে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী এবং দক্ষিণ সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আতাউর রহমানও সংশ্লিষ্টদের একজনের নামে ফলক লাগানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। মুক্তিযোদ্ধা-জনতার বাঁধার প্রেক্ষিতে অবশেষে ফলক লাগানো থেকে বিরত থাকেন সংশ্লিষ্টরা।
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের নেতা ওবায়দুর রহমান কুবাদ বলেন, কয়েক মাস আগ থেকে একটি চক্র মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত একটি সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। আমরা এ বিষয়টি জানতে পেরে সংশ্লিষ্টদের তিনজনের নামে ফলক লাগানোর পরামর্শ দিয়েছি। একজনের নামে ফলক নির্মাণ হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস চাপা পড়বে। সংশ্লিষ্টরা আমাদের অনুরোধ রেখেছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর কবীর আহাম্মদ বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে প্রকৃত ইতিহাস জানার পর আমরা শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়কে বিষয়টি অবগত করেছি। তিনি আমাদেরকে তিন যোদ্ধার নামেই ফলক নির্মাণের কথা জানিয়েছেন।