সাহেরীন আহমদ চৌধুরী মিশুক ::
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সবচেয়ে কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। দেশের বেশিরভাগ মানুষ তাদের ভোট দেয়ার সুযোগও পায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। ইউনিয়ন নির্বাচন আসলে গ্রামাঞ্চলে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। এবারের নির্বাচনে অসঙ্গতির কমতি ছিল না।
প্রথমত, দলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনা এখনও ওই স্তরে যায়নি যে তারা দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিবে। এ ধরনের নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলে একই গোত্র, পরিবার থেকেও প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা যায়। কিন্তু এবার দলীয় প্রতীকের কারণে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে ঠিকই তবে দলীয় আবেগের কারণে তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে। আগে জাতীয় নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিবদমান বিরোধ কিছুদিন বা বছরখানেক পর শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এখন সংসদ, উপজেলা, সিটি, পৌরসভা, ইউনিয়ন প্রতিটি নির্বাচন দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মনে করিয়ে দেবে তাদের প্রতিপক্ষের কথা। তাদের মধ্যে এক নির্বাচনের বিরোধ কাটতে না কাটতে আরেকটি নির্বাচন চলে আসবে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে নির্বাচনী সহিংসতা কমার চেয়ে বরং বাড়ার লক্ষণই বেশি। অবশ্য এর মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদি কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তবে তা ভিন্ন কথা।
দ্বিতীয়ত, এবারের ইউনিয়ন নির্বাচন ছয় ধাপে করে নির্বাচন কমিশন কি লাভ করেছে? ছয় ধাপের নির্বাচনে সারাদেশে প্রায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। একদিনে নির্বাচন করলে কি এত মানুষ মারা যেতো। ছয় ধাপের নির্বাচনে লাভ হয়েছে মনোনয়ন ব্যবসায়ী ও দুষ্কৃতকারীদের। ধাপে ধাপে নির্বাচন হওয়ায় দলীয় মনোনয়নের দামও বেড়েছে ধাপে ধাপে। যারা মনোনয়ন কারবারি তারা খদ্দের আকর্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ পেয়েছেন। অপর পক্ষে যারা দুষ্কৃতকারী তারাও একটার পর একটা ‘দাও’ মারার সুযোগ পেয়েছে। তাদেরই বা দোষ কীসের? নির্বাচন কমিশন তাদের আয় রোজগারের জন্য লম্বা সময়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের গ্রুপিং একটা নিয়মিত ঘটনা, হোক তা সরকার দল বা বিরোধী দল। এবারের ইউপি নির্বাচনের ফলে এ গ্রুপিং এখন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছালো। নির্বাচনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিরোধী প্রার্থীর জয় তারই প্রমাণ। এই বিরোধের ফলাফল পাওয়া যাবে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। যে প্রার্থী লাখলাখ টাকা খরচ করে মনোনয়ন কিনে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে সে কি তার টাকা উসুলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে এই নেতা যখন জেলা বা কেন্দ্রের নেতা হবে তখন কি সে একই কায়দায় বা তার চেয়ে উন্নত কায়দায় মনোনয়ন বাণিজ্য করবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে।
চতুর্থত, এবারের নির্বাচনে কমিশন তাদের ক্ষমতার কতটুকু ব্যবহার করতে পেরেছে। তারা কি তাদের গা বাঁচিয়ে চলেছে? নাকি তারা দায়সারা কাজ করতে চেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের উপর তো কারো চাপ থাকার কথা নয়। তাছাড়া মানুষের জান-মাল রক্ষায় যদি তাদের কঠোর হতে হয় তাতে কি সরকার কোন বাধা দিবে। অনেক সময় লক্ষ্য করেছি যে, কমিশনের সংশ্লিষ্টদের কথায়ও আশ্বস্ত হওয়া যায় না। মনে হয় তারা যা বলছে তাতে তারা নিজেরাই সংকল্পবদ্ধ নয়। তাদের এমন অভিব্যক্তি শুরু থেকেই। এর আগের কমিশনকে দেখেছি দৃঢ়তার সাথে কথা বলতে। তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা কি তা বলব না তবে এটুকু বলতে পারি মানুষ তাদের বিশ্বাস করেছিলো যে তারা কিছু করতে পারবে।
সবশেষে, সহিংসতায় শতাধিক মানুষ মারা গেল (এর মধ্যে প্রার্থীও ছিল), আরও বহু মানুষ আহত, তাদের বিষয়ে কমিশন কি বলবে, যারা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করে তাদের হারিয়েছে বা যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছে তাদের বিষয়েই বা দলগুলো কি পদক্ষেপ নিবে। হয়তো বা কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা বলবেন শতাধিক মানুষের প্রাণহানি অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক ঘটনা। অপরপক্ষে দলগুলো বিদ্রোহীদের সাময়িক বহিষ্কার করবে আবার যারা বিদ্রোহ করেও বিজয়ী হয়েছে তাদের নানা কৌশলে দলে ভেড়াবে।
[ংধযবৎরহসরংযঁশ@মসধরষ.পড়স]