চিত্তরঞ্জন তালুকদার ::
অজানা দেশে চলে গেলেন অগ্নিযুগের চারণ বিপ্লবী ভেটারেন কমরেড লালমোহন রায়। মধ্যনগর ধরমপাশা তথা সুনামগঞ্জ জেলার সর্বশেষ ব্রিটিশ, আইয়ুব, এবং স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ত্রিকালব্যাপী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কর্মী ছিলেন লালমোহন রায়। ২০০৪ সনের নভেম্বরে লালমোহন রায় ৯২ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টি বিলোপবাদী চক্রান্ত থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর পুনর্বার স্থানীয় মধ্যনগর শাখার সদস্য হন। ১৯১২ সালের ১ মে মধ্যনগর ইটাউড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লালমোহন রায়। পিতা প্যারীমোহন রায় মাতা হেমলতা রায় পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়, তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জের খাগাউড়া গ্রামে। লালমোহন রায় বাল্যকাল থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে দু’দিক থেকে নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
প্রথমত ’৬৫-তে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাতে দলে ভাঙ্গন বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, পার্টি কমরেডরা নানাভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন কিন্তু লালমোহন রায় টিকে রয়েছেন, এটাই ছিল তাঁর পার্টি-জীবনের চরম সাফল্য। অপরদিকে অভাবগ্রস্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে লালমোহন রায় নিজ প্রতিভা বলে নিজেকে রাজনীতির ধারায় ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেয়েছেন। পরিবার মধ্যনগরে মাতুলালয়ে অবস্থান করলেও তিনি শুধু লেখাপড়ার জন্য দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সহায়তায় পিতার জন্মস্থান হবিগঞ্জের বিরাট চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থায় ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনের সামাজিক নানা প্রতিবাদী সংগঠনÑ ‘বিপ্লবী তরুণ সংঘ’ ও ‘ওয়েলফেয়ার সংঘ’ গড়ে ওঠে। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় এসব সংঘের কাজে-কর্মে যোগদান করেন। এসব খবর যে মধ্যনগর মামাবাড়িতে জমিদার মামা ভারত রায় পর্যন্ত আসত না তা নয়। পরিবার একটা সুযোগের অপেক্ষা করছিলÑমামা ভারত রায়ের ইচ্ছা ছিল ব্যবসায়ে নিয়োজিত করা। তা না হলেও তিন বছর পর মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসার পর মধ্যনগরে প্রথম এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে কমিটির প্রধান ভারত রায় তাঁর ভাগ্নেকে অনায়াসে স্কুলে শিক্ষক বানিয়ে আটকে দিলেন। লালমোহন রায় প্রথমে বুঝতে পারেন নাই, তাই প্রাণপণে ছাত্রদের বুঝাতেন ভারত মাতার পরাধীনতার কথা। ভালো ভালো ছাত্রও পেয়েছিলেনÑ দেশবরেণ্য সাহিত্যিক শাহেদ আলী ও চেয়ারম্যান আমির আলীসহ তাঁর প্রিয় অনেক ছাত্র ছিলেন। পরে ১৯৩৫ সনের দিকে বিপ্লবী দলের চিঠি আসার পর এ বাঁধন ছিন্ন করে হবিগঞ্জের জলসুখা চলে যান। সেখানে ১৯৩২ সনের ডাক-লুটের টাকা দিয়ে নানা স্থানেÑবিপ্লবীদের জন্য নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান করা হয়। আজমিরিতে টেইলারিং হাউজ, সুনামগঞ্জের ট্রাফিক পয়েন্টে বই-এর দোকান (স্টুডেন্টস লাইব্রেরি), সাচনাবাজারে বুক বাইন্ডিং-এর দোকান, সিলেটের জিন্দাবাজারে দেবেন শ্যামকে দিয়ে বই-এর দোকান করা হয়। প্রথমে তাঁকে আজমিরিতে টেইলারিং হাউজের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে সিলেট এনে তাঁতিপাড়া অমর সুধার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাসহ তাঁর বুক বাইন্ডিংয়ে যাওয়া ও কাজ শেখার কথা বলা হয়। কিছুদিন পর সিলেট শহরের নাইওরপুল ‘প্রেস ওয়ার্কার্স’-এ কাজ করার উদ্দেশ্যে ‘সারদা প্রেসে’ কাজ শেখার জন্য ভর্তি করা হয়। এই সূত্র ধরেই পরবর্তীতে “সিলেট জেলা প্রেস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন” গঠন করেন। পার্টি তখনও গোপনে কংগ্রেসের মধ্য থেকে কাজ করতো।
সিলেট রিকাবী বাজারের পুলিশ লাইনে ক্যাম্পের পাশে বুলি লালাদের একটি পতিত জমি ছিল। এই মাঠে বাগান করার নামে লালমোহন রায় ও অন্য কয়েকজন বিপ্লবী ডেরায় অবস্থান নিয়ে কামলা সেজে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ধরে আনা, নির্যাতন করা, কোথায় রাখবে নেবে ইত্যাদি খবর সংগ্রহ করে চিরকুটের মাধ্যমে মূল নেতৃত্বের কাছে খবর পৌঁছানোর ইতিহাস বলতে যেয়ে অনেক আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। বর্তমানে দেয়াল দিয়ে মাঠটি ঢেকে দিলেও এ রাস্তায় পেরুতে গেলেই এই ব্রিটিশ-পুলিশের কমিউনিস্ট-নির্যাতন ক্যাম্পটির অব্যক্ত অনেক দৃশ্য স্মৃতিতে যে কোন কমরেডের মনে জেগে উঠে। আর এখন হয়তো যে কোন প্রাণপ্রিয় কমরেড লালমোহন রায়ের যুব বয়সের টগবগে জীবন্ত ছবিটিই দেখতে পাবেন। পরে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার দাসেরবাজারে তাঁকে কৃষকদের মাঝে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। দাসের বাজারে গিয়ে কিছুদিন কাজ করে অল্পায়াসেই একটি কৃষক কর্মীসভার আয়োজন করেন। বুলিলালা, রোহিনী দাস, পূর্ণেন্দু সেন, অবলা গুপ্ত, নলিনী গুপ্ত মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। তাঁকে সেখানে স্থায়ীভাবে কাজ করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। দীর্ঘদিন গণসংযোগ করে ছাপ্পান্নটি মৌজার একটি কৃষক সমিতি সেখানে গঠন করেন। তখন সেখানে গোপনে কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রকাশ্যে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেন। ঠিক এই সময়ে নেতাজী সুভাষ বসুর কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচনে সিলেট অঞ্চলে ডেলিগেট হিসেবে লালমোহন রায় ও সুনামগঞ্জ থেকে রবি দাম গোটা আসাম অঞ্চলের প্রতিনিধিদের সাথে কোলকাতায় গিয়ে ভোট দেন। সুভাষ বোস কংগ্রেসের সভাপতি নির্বচিত হন। ভারতে কংগ্রেসের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হয়।
বড় বক্তা বা তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন না লালমোহন রায়। কিন্তু ছোট খাটো দেহের অধিকারী হওয়ায় এত প্রতিকূলতার মাঝে গ্রেফতার এড়িয়ে সংগঠিত করার কাজে খুব পটু ছিলেন। এসব নানা কাজের মধ্যদিয়ে দেশভাগ হওয়া পর্যন্ত তিনি জেলার বাইরে হবিগঞ্জ মৌলভীবাজার সিলেটে কাজ করেছেন। ফলে নিজ জেলার অনেক বড় বড় ঘটনায় তিনি সম্পৃক্ত হতে পারেন নাই।
বিভাগ পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির উপর নানা বাধা-নিষেধ থাকায় পাকিস্তানি স্বৈর-শাসনের শুরুর দিকে কৃষক আন্দোলন ও অন্যান্য শোষণ-বঞ্চনার আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবু অনাকাক্সিক্ষত দেশভাগ ও নানা বৈষম্যের চিত্র বাঙ্গালি সমাজে নতুন রেখাপাত করে, ৫২’র ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী শিক্ষা ইত্যাদি আন্দোলনের ফলে জনজীবনে নতুন সংগ্রামের সুর মানুষের মনে দানা বাধতে থাকে। এই সময়কালে লালমোহন রায় পারিবারিক চাপে অনেকটা অপারগ অবস্থায়ই একটু বেশি বয়সেও বিয়ে করতে সম্মতি দেন এবং বানিয়চঙ্গে এক সাধারণ পরিবারের সাদাসিধে মেয়ে অঞ্জলি রায়কে বিয়ে করেন। জীবনের অনেক বেলা পার হয়ে গেলেও বাঁচার অবলম্বন হিসাবে তখনকার সময়ের সস্তা চাকুরি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতায় যোগদান করেন। বড়ভাই ডাক্তার ললিতমোহন রায় ও পরিবারের অন্যেরা উছৃঙ্খল ঘরছাড়া ছেলেকে ঘরবন্দি করতে পেরে যেন হাঁফছেড়ে বাঁচলেন।
স্বাধীনতার পর থেকে তিনি এলাকায়ই অবস্থান করেন, সবকারি চাকুরি করেও তিনি পার্টিতে গোপনে যুক্ত ছিলেন। প্রকাশ্যে কোন কাজ না করতে পারলেও মধ্যনগর এলাকায় তিনি অনেক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষককে পার্টিতে যুক্ত করেন এবং নিজহাতে ’৯০ সাল পর্যন্ত ১০০ ‘একতা’ বিক্রি করে বিল পরিশোধ করেছেন। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। বড়ছেলে তাপস বাড়ি-সম্পত্তি দেখাশুনা করে, ছোট ছেলে তিতাস বাড়ি থেকেই প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছে, বড় মেয়ে শেলি সুনামগঞ্জ শহরে থেকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করছে, ছোট মেয়ে তুলনাও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। গত এক দশক প্রায় বধির ও মূক অবস্থায় কাটিয়ে পিতৃপুরুষের জন্মের ঋণ শোধ দিয়ে ৩ জুন ২০১৬ শুক্রবার বিকেল ৪টায় ১০৪ বছর বয়সে চিরবিদায় গ্রহণ করেন বিপ্লবী কমরেড লালমোহন রায়।
অগ্নিযুগে সুনামগঞ্জ-সিলেটের বিপ্লবীদের নানা লোমহর্ষক ঘটনা,অনেক বিপ্লবীর জীবনের করুণ কাহিনী ও বীরত্বগাঁথা অনেক জেলার অগণিত বিপ্লবীর নাম লালমোহন রায় শুনিয়েছেন। শতবর্ষী একজন অভিজ্ঞ মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ জানা-শোনা ঘটনার কাহিনীগুলি আজকের প্রজন্মকে না জানাতে পারলে শুধু বীজ গণিতের ফর্মুলা বুঝিয়ে খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। তাই পর্যায়ক্রমে লালমোহন রায়ের মুখ থেকে শুনা ঘটনাগুলি আলোচনা করছিÑ
লালা শরদিন্দু দে বুলি ছিলেন সুনামগঞ্জ জুবিলী স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ব্রিটিশ কোন এক পদস্থ কর্মকর্তার ‘জুবিলী স্কুল’ পরিদর্শন বা এমনই এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘যুব সংঘ’-এর আহ্বানে ছাত্রদের স্কুলে স্ট্রাইক ও ক্লাস বর্জনের গোপন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ঘটনার দিন যথাসময়ে সব ক্লাশের ছাত্র হুড়মুড় করে ক্লাস বর্জন করে বের হয়ে যায়। শিক্ষক হাজিরাখাতা হাতে ক্লাসে গিয়ে কোন ছাত্র না পেয়ে প্রধান শিক্ষকের নিকট রিপোর্ট করেন। বিষয়টিতে প্রধান শিক্ষক ইংরাজ কর্মকর্তার সামনে ভীষণ লজ্জিত হন এবং তদন্তে করে যে ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছে তাকে ‘রাজটিকিট’ করে চিরতরে বহিষ্কার করেন। পরবর্তীতে বোর্ড থেকে সচিব এসে বলেছেনÑ ‘আপনি যাকে বহিষ্কার করেছেন সে তো আপনার ছেলে, তা আপনি তুলে নিন।’ প্রধান শিক্ষক লালা প্রসন্ন কুমার দে উত্তরে বলেছেনÑ ‘প্রতিষ্ঠানের নিয়ম ভঙ্গ করেছে যে ছেলে আমি তাকে ‘রাজটিকিট’ করেছি, আমি তা ফিরিয়ে নিতে পারবো না।”
তাৎক্ষণিক পদত্যাগপত্র লিখে অফিসারকে দিয়ে বলেছেন- নিন আমি পদ থেকে সরে দাঁড়ালাম আপনি ফিরিয়ে নিন। বাঙালির সততা ও নৈতিকতার জোর দেখে ইংরাজ অফিসার হাতজোড় করে প্রধান শিক্ষককে অভিবাদন জানিয়েছে, ধন্যবাদ দিয়েছে। সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুলের তৃতীয় প্রধান শিক্ষক কালজয়ী সিংহ পুরুষ লালা প্রসন্ন কুমার দে’র নাম এখনও স্বর্ণাক্ষরে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে স্কুলের বোর্ড তালিকায়। আর মাথায় ‘রাজটিকিট’ নিয়ে লালা শরদিন্দু দে নাইন পাশ যোগ্যতায় ‘বুলি লালা’ নামে সারা জীবন কমিউনিস্ট রাজনীতি করে গেছেন।
তখন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের স্কাউট দলেও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের কর্মকান্ড চালচলন ভীষণ প্রভাব বিস্তার করে এবং তৎকালীন সরকারি নির্দেশনার প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি সাধারণ জনগণ ও মহিলা মহলেও এ গণসংগ্রামের ঢেউ লাগতে থাকে। তৎকালীন সময়ে সিলেটে মেয়েদের লাঠি-ছুরাখেলার দল কলেজ অনুষ্ঠানে ক্রীড়া প্রদর্শন করে বাহবা কুড়িয়েছে। সুনামগঞ্জে একবার এক সরকারি কর্মকর্তাকে অভিবাদন জানাতে স্কাউট দল জাহাজঘাটে যেতে অসম্মতি জানায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে। এসব হলো পর্যায়ক্রমে স্বদেশী আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল।
সিলেটে রতনমণি টাউন হলের সামনে প্যান্ডেল নির্মাণ করে বাজনৈতিক সম্মেলন ও যুব সম্মেলন একসাথে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে নেতাজী সুভাষ বসু উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অন্য কারণে তা হয়নি, তবে ভারত কাঁপানো বক্তা হবিগঞ্জের সুসন্তান বিপীন পাল উপস্থিত ছিলেন। সেখানে লাঠি-ছুরাখেলার নানা প্রক্রিয়া প্রদর্শন করা হয়, কীভাবে লাঠির সাহায্যে রাইফেলের গুলিও প্রতিহত করা যায় তারও নমুনা দেখানো হয়। পরে এই সম্মেলনে সুবোধ দত্ত নামে এক লাঠিয়াল ও কুস্তিগীর চলন্ত গাড়ি আটকে রাখার সাহস দেখালে উৎসুক জনতা তা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে। চারিদিক থেকে সাধারণ জনতার ঢল নামে সুবোধ দত্তকে ঘিরে তা দেখার জন্য হুমরি খেয়ে পড়ে। একদিকে মোটর গাড়ির পিছনে মোটা রশি বেঁধে আর এক দিকে সুবোধ দত্তের কোমরে বেঁধে ফুলস্পিডে গাড়ি চালিয়েও তাকে একচুল নাড়াতে পারে নাই। চারিদিকে উৎফুল্ল জনতার করতালিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। লালমোহন রায় এসব কাহিনী বলতেন আর এখনকার অকর্মণ্য জীবন-যাপনের সাথে তুলনা করে বুঝাতেন। আমি ও আমরা যারা থাকতাম সবাই অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতাম। একবার নেহেরুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রস্তাব আনা হয় তা পালন করার জন্য সিলেট শহরে হিড়িক পড়ে যায়। ২৬ জানুয়ারি এই দিবসটি পালনের জন্য প্রভাতফেরি পতাকা উত্তোলন গান্ধীটুপি পরা, ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ব্যাজ বুকে ধারণ করার আনুষ্ঠিনিকতায় পাড়া মহল্লা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ঐ সময় মুরারী চাঁদ কলেজে ত্রৈমাসিক পরীক্ষা চলছিল। পরদিন ক’জন ছাত্র গান্ধীটুপি ও ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ব্যাজ পরে পরীক্ষার হলে সিটে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রদর্শক প্রফেসার একজন ছাত্রকে টুপি খুলে পকেটে রাখতে বলায় সে তাই করে। হলের অন্যপাশে আর একজনকে বললে সে টুপি খোলার কারণ জানতে চাইলে তাকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অপর একজনের শুধু ব্যাজ পরা ছিল সে এই বহিষ্কারের প্রতিবাদ করায় তাকেও বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরদিন সব পরীক্ষার্থী ছাত্র হয় গান্ধীটুপি নয় ত্রিবর্ণ ব্যাজ, কেউ কেউ টুপি ও ব্যাজ উভয়টি নিয়েই পরীক্ষার হলে উপস্থিত হয়। ছাত্রদের এই সংগ্রামী মনোভাব দেখে সেদিন কর্তৃপক্ষ আর কোন বাধা-নিষেধ আরোপ করতে সাহস পায় নি এবং এও বুঝতে পারলো যে পরবর্তী আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্ররাই নেবে অগ্রণী ভূমিকা।
সম্ভবত ’২৪ সনের দিকে সুনামগঞ্জে সুরমা উপত্যকা রাজনৈতিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সরোজিনী নাইডু। সেদিন সুনামগঞ্জবাসী দেখেছিল ছাত্র-যুব সমাজের মনে ব্রিটিশ বিদ্বেষ কী পরিমান পুঞ্জিভূত হয়েছে। প্যান্ডেল এলাকা লোকে লোকারণ্য, নারী-পুরুষ কোন শ্রোতা-দর্শকের কমতি নেই। ইংরেজিতে বক্তৃতা তবু মানুষের কোন ধরনের হই হট্টগোল নেই। মাইকের প্রচলন ছিল না নাইডুর কথা বলার স্টাইল, স্বরের উঠানামা মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। এক পর্যায়ে একজন করতালি দিয়েছে তো হাজার মানুষ করতালিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছে সাথে সাথে অপরদিকে মেয়ে মহলে উলুধ্বনি দিয়ে চারিদিক মুখরিত করে দিয়েছে। বুঝা গেছে সেদিন হাজার হাজার যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী ব্রিটিশদের আর সহ্য করতে পারছে না।
মুরারী চাঁদ কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন ছিল ছাত্রদের নির্বাচিত ইউনিয়ন। এই ফোরামটি তাদের নিজস্ব নিয়মে চলতো তাই এটাকে নষ্ট করার জন্য কর্তৃপক্ষ নির্বাচন ও মনোনয়নের নতুন নিয়ম করে। ছাত্রনেতারা তার তীব্র প্রতিবাদ করে এবং ইউনিয়নের জন্য আদায়কৃত চাঁদা ফেরত দেওয়ার দাবি জানায়। চাঁদা ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা কোন প্রতিবাদ আন্দোলন না করার বন্ড না দিলে সুধাংশু মনীন্দ্র দ্বারকানাথ গোস্বামীকে বহিষ্কারের হুমকি দেয়। গোটা কলেজের ছাত্র তাতে ফুঁসে উঠে এবং সর্বাত্মক ধর্মঘট ডাকে। এতে কর্তৃপক্ষ ঘাবড়ে যায় এবং বহিষ্কার আদেশ তুলে নিতে বাধ্য হয়। লালমোহন রায়ের কাছে এই প্রথম শুনলাম ’৩০ সনের দিকেও ছাত্র ইউনিয়ন নামটি ছিল। এটাই হয়তো বায়ান্ন সনে প্রথমে সিলেটে পরে ঢাকায় প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। লালমোহন রায়ের কাছে নানা ঘটনা, বীরত্বপূর্ণ কাহিনী শুনে ২০০৮ সালের দিকে তাঁরই সমবয়স্ক ‘কমরেড শ্রীচঞ্চল শর্মা’র ‘শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলন’ ‘স্মৃতিকথা’ নামক ওরিয়েন্টাল বুক কোম্পানি, কোলকাতা-১৭ কর্তৃক প্রকাশিত একটি বইয়ের ফটোকপি ধরমপাশার প্রয়াত কমরেড দীনেশ চৌধুরীর ভাতিজা ভানু চৌধুরী আমাকে দেন। বইটি পড়ে বৃহত্তর সিলেট ও কাছার অঞ্চলের তখনকার বিপ্লবীদের নানা বীরত্বপূর্ণ ও লোমহর্ষক অনেক ঘটনা জানলাম এবং লালমোহন রায়ের বলা অনেক ঘটনাই এখানে পেলাম। সাথে সাথে বইটি নিয়ে মধ্যনগর গেলাম এবং লালমোহন রায়কে দেখালাম, পড়ে শুনালাম। তিনি তো আবেগাপ্লুত হয়ে বইসহ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং পরে যা বুঝালেন বইটা যেন অনেককে পড়াই পারলে বইটা যেন নতুন করে পার্টি ছাপায় এ অনুরোধ করেন। সুরমা ভ্যালিতে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি’র যে কমিটি আমি লালমোহন রায়ের কাছে পেয়েছিলাম তা এই বইয়ে পেলাম তাই বিশ^াস হয় তাঁর বলা কাহিনীগুলি কমবেশি থাকতে পারে অতিরঞ্জিত নয়। আমার দেহের মনের প্রাণের অন্তরের সকল শক্তি দিয়ে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও শতকোটি লালসালাম জানালাম, আমরণ আমার সহমর্মিতার হাত প্রসারিত থাকলো তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের সকলের প্রতি।
[লেখক : চিত্তরঞ্জন তালুকদার, সহকারী অধ্যাপক, সুনামগঞ্জ পৌর কলেজ, সুনামগঞ্জ।]