বিশেষ প্রতিনিধি ::
প্রথম বারের মতো সারাদেশে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও সুনামগঞ্জের অনেক এলাকায় ইউপি নির্বাচনে ‘আঞ্চলিকতা’র প্রবণতা দেখা গেছে। জেলার ৮৫টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনেক স্থানেই উন্নয়নের জন্য আঞ্চলিকতার ইস্যু তুলে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিয়েছেন প্রার্থীরা। এমনকি দলীয় অনেক প্রার্থীকেও অনেক ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাকে মেনে নিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। নির্বাচনী বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, গ্রামীণ মানুষ দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে বেরিয়ে আসতে আরো সময় লাগবে। তাঁরা বলছেন, আঞ্চলিকতার জিকির তুলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যেসব প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন তাঁরা যেন উন্নয়নের প্রশ্নে আঞ্চলিকতাকে ভুলে প্রতিটি গ্রামের উন্নয়নেই ভূমিকা রাখেন।
সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নির্বাচনে অংশ নেওয়া চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাই স্থান পেয়েছে। সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নকে দ্বিখন্ডিত করেছে সুরমা নদী। নির্বাচনে নদীর উত্তরপাড়ে এক প্রার্থী এবং দক্ষিণ পাড়ে ছিলেন দুই প্রার্থী। ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে নদীর উত্তরপাড়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. নূরুল হক নিজ এলাকার উন্নয়ন, বিদ্যুতায়নের ইস্যু তুলে তাঁর এলাকার সাত গ্রামকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ফলে সামান্য ভোট বাদে অধিকাংশ ভোটই তাঁর বাক্সে পড়ে। তাঁর এলাকায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তাজুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী মঈনুল হক সামান্য ভোট পেয়েছেন। ঠিক নদীর দক্ষিণ পাড়ে মোহনপুর গ্রামের প্রার্থী তাজুল ইসলাম নিজ গ্রামের নিরঙ্কুশ ভোট প্রাপ্তিসহ আশপাশের প্রতিটি গ্রাম থেকেই সম্মানজনক ভোট পেয়েছেন। তাঁর মতো আওয়ামী লীগ প্রার্থীও একই এলাকা থেকে সমপরিমাণ ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. নূরুল হক নদীর দক্ষিণ পাড়ে খুবই কম ভোট পেয়েছেন। নদীর দক্ষিণপাড়ে এই দুই প্রার্থী এগিয়ে থাকলেও মোট ভোটের হিসেবে নদীর উত্তরপাড়ের গ্রামের নিরঙ্কুশ ভোট পাওয়ায় নির্বাচিত হন মো. নূরুল হক।
একইভাবে কাঠইর ইউনিয়নে নির্বাচিত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী মো. শামছুল ইসলাম তাঁর জন্মএলাকা শাখাইতি গ্রামের নিরঙ্কুশ ভোট একা পেয়েছেন। অন্য প্রার্থীরা যৎসামান্য ভোট পেয়েছেন তাঁর কেন্দ্রে। এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. বুরহান উদ্দিন, জাতীয় পার্টির প্রার্থী ফারুক আহমদ, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লুৎফুর রহমান, আব্দুল মতিন মাস্টার, আব্দুল মতিন এবং আঞ্জব আলীসহ সকল প্রার্থী নিজ নিজ কেন্দ্রে অধিকাংশ ভোট পেয়েছেন। ওই কেন্দ্রগুলোতে জমিয়ত প্রার্থী কোন সুবিধা করতে পারেননি।
একই উপজেলার সুরমা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ডিলার এবং বিদ্রোহী প্রার্থী আমির হোসেন রেজার ভোটও আঞ্চলিকতা ইস্যুতে ভাগাভাগি হয়েছে। এই দুই প্রার্থী নিজ নিজ এলাকার অধিকাংশ ভোটই পেয়েছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা, পূর্ব বীরগাঁও, পাথারিয়া, শিমুলবাক ইউনিয়নেও আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও, বাংলাবাজারেও আঞ্চলিকতার ইস্যু তুলে বিজয়ী হয়েছেন প্রার্থী।
শেষ ধাপে শেষ হওয়ায় অধিকাংশ ইউনিয়নেও আঞ্চলিকতার প্রভাব ছিল। সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আমান রাজা চৌধুরী বৃহত্তম গ্রাম রাজাপুরে একক অন্য প্রার্থীকে পিছনে ফেলে এলাকার বেশির ভাগ ভোট পেয়েই তিনি নির্বাচিত হন। সেলবরষ, চামরদানিসহ অন্যান্য ইউনিয়নেও একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়নেও একইভাবে নদীর দুই পাড়ের ভোটাররা বিভক্ত হয়ে পড়ায় নিজ নিজ প্রার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এই ইউনিয়নে সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার বাসিন্দা হিসেবে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আলহাজ্ব জহুর আলী নির্বাচিত হন। এভাবে জেলার কমবেশি প্রতিটি ইউনিয়নেই আঞ্চলিকতার জিকির তুলে প্রার্থীরা প্রচারণা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত কাক্সিক্ষত জয়ও পেয়েছেন।
ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, এলাকার মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। আমি তাদের কাছে ঋণী। তবে উন্নয়নের প্রশ্নে আমি একচোখা নীতি অবলম্বন করবো না। ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামেই সমানুপাতিকহারে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়ন করব। তিনি বলেন, যারা ভোট দিয়েছেন বা দেননি আমি তাদের সবার চেয়ারম্যান।
স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রথম বারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জনগণকে পুরোপুরি দলীয়ভাবে এই নির্বাচনকে গ্রহণ করতে হলে আরো বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় সংঘাত ও খুনোখুনি বেড়েছে। আগামীতে ক্ষমতাসীনদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।