সালেহ্ আহমদ আলমগীর ::
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। তের-চৌদ্দ বছরের এক কিশোর। লিখে রাখিনি বলে সঠিক দিন তারিখ মনে নেই, তবে ফিরে তাকালে সে সময়ের অনেক কিছুই, অনেক ঘটনাই আজও বেশ স্পষ্ট দেখতে পাই।
সুনামগঞ্জ তখনও জেলা হয়নি, মহকুমা। এই মহকুমার তাহিরপুর থানার উত্তর প্রান্তে পাক-ভারত সীমান্তঘেঁষা একটা জায়গা টেকেরঘাট। ‘চুনাপাথর খনি প্রকল্পের’ অবস্থানের কারণে জায়গাটা বেশ প্রসিদ্ধ। মে মাসে ৫নং সেক্টরের অধীনে একটা সাব-সেক্টর হিসেবে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুর দিকেই অর্থাৎ মে মাসেই আমার বাবা টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রায় একই সময়ে এই সাব-সেক্টরেই রেজিমেন্টাল মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন আমার মামা, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, তরুণ চিকিৎসক ডা. মো. নজরুল হক। যুদ্ধের পুরো সময়টাতে আব্বা ও মামা দু’জনে মিলে সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা, প্রকল্পের আটকেপড়া কর্মচারীদের গুটিকয় পরিবার এবং সংলগ্ন মুক্তাঞ্চলের জনসাধারণের চিকিৎসাসেবা দিয়ে গেছেন।
আব্বা টেকেরঘাটে অবস্থান শুরু করলে আম্মার সাথে আমরা ৫ ভাই-বোনও সেখানে চলে যাই। ‘টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের’ অনেকগুলো আবাসিক কোয়ার্টারই তখন খালি পড়েছিল, এরই একটাতে মামা-সহ আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। সম্ভবত সেপ্টেম্বরে নিরাপত্তা-ইস্যুতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পার্শ্ববর্তী এলাকা ‘বড়ছড়া’য় আশ্রয় নেওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ ক’মাস আমরা সেই বাসাতেই ছিলাম।
বাসার সামনেই একটা মাঠ। বারান্দা থেকে পুরো মাঠটাই দেখা যায়। ফুটবল খেলার মাঠই হবে, দু’পাশে লোহার পাইপ দিয়ে বানানো গোল পোস্ট। ফুটবল খেলা আর হয় না, এখন মুক্তিযোদ্ধারা পিটি-প্যারেড করেন। একপাশে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড। প্রতিদিনই জাতীয় পতাকা উড়ে। সবুজের কোলে লাল বৃত্তের মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র, যেন গোটা বাংলাদেশটাই উড়ছে। সকালে উঠানো হয় পতাকা, নামানো হয় সন্ধ্যাবেলায়। পতাকা উঠানো ও নামানোর সময় কোনও কোনও দিন ক্যাম্পে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন দাঁড়িয়ে বিন¤্র শ্রদ্ধায় কণ্ঠ মেলান- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ…’। তাঁরা কেউ গায়ক নন, স্কুল কলেজেও পড়েননি, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ প্রায় সবাই। তাঁদের অনভ্যস্ত কণ্ঠে কী এক যাদু এসে ভর করে। সমস্ত প্রকৃতি যেন তাঁদের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। পাখ-পাখালি নিজেদের গান থামিয়ে দেয়। পাশের বিশাল খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময়টাতে আব্বা প্রায়শঃ বাসাতেই থাকেন। তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে থাকেন, ধীরে ধীরে পতাকা উঠতে থাকে, পতাকা নামতে থাকে, আর আব্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধরাগলায় তাঁদের সাথে গাইতে চেষ্টা করেন- আমার সোনার বাংলা…। অদম্য কান্নার দমকে আর পেরে ওঠেন না। দু’চোখ প্লাবিত হয় অশ্রুধারায়। কোথায় থাকে এত অশ্রু? যেদিনই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে আব্বা এরকমটিই করবেন- আমরা ভাইবোনেরা সবাই জানতাম। তবে কারণটা বুঝতাম না। ছোট ছিলাম, সাহস করে জিজ্ঞেসও করতাম না। আব্বাকে আমাদের সামনে বিব্রত হতে না দিয়ে শুধু নিজেরা আড়ালে চলে যেতাম। এখনতো অনেক বড় হয়েছি, জানতে চাইতেই পারি- আব্বা অমন করে কেন কাঁদতেন? একদিন দু’দিন নয়, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার প্রায় প্রতিটি দিনই। তাঁরা গাইছেন- আব্বা কাঁদছেন, পতাকা উঠছে-নামছে, আব্বা কাঁদছেন; কেন আব্বা?
সেই দিনগুলোতে আমাদের ছোটদের করার তেমন কিছুই থাকতো না। সমবয়সী দু’চারজন মিলে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করা, মাঝে মাঝে পাশের পাহাড়ে উঠা, প্রতিবারই সাহস করে আরও একটু গহীনে ঢুকে নিত্য-নতুন আবিষ্কারের রোমাঞ্চ উপভোগ করা, চিকন বাঁশ কেটে এনে ‘পটাশ’ নামের একধরনের অস্ত্র বানানো, বিকেলে মুক্তিবাহিনী আর পাঞ্জাবী দু’দলে ভাগ হয়ে ‘রেকি’, ‘অ্যাম্বুশ’ ইত্যাদি মিলিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা- এভাবেই দিন কাটতো। আর রাত যেন শেষই হতো না। আমাদের এই অর্থহীন সময় কাটানো দেখে বখে যাওয়ার আশংকায় কিংবা আমাদের লেখাপড়ার অনিশ্চয়তায় কি আব্বা অপরাধবোধে ভুগতেন? স্কুল নেই ক্লাস নেই, সামনে কোন পরীক্ষা নেই, তবু সন্ধ্যাবেলা আমাদের পড়তে বসতে বলতেন কেন?
আগস্ট মাসের এক সকাল। দশটা-এগারটা হবে। বাসা থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরছি। হঠাৎ দেখি আব্বা দৌড়ে তাঁর হাসপাতাল কাম ডিসপেনসারির দিকে যাচ্ছেন। আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি মামাও সেখানে। ডাক্তারের ছেলে- রোগী, রক্ত, ইন্জেকশন, সেলাই- এসব দেখে মোটামুটি অভ্যস্ত। কিন্তু সেদিন যা দেখলাম, এর আগে ওরকম কিছু দেখা তো দূরের কথা আমার ভাবনাতেও ছিল না কোনদিন। অল্প কথায় বলতে গেলে- জামালগঞ্জের এক অপারেশন (যুদ্ধ) থেকে আহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজকে পাঠানো হয়েছে। ভোরবেলা আহত হয়েছেন। গুলি ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার বামপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। রক্তপাততো হচ্ছেই, মগজের কিছু অংশও বেরিয়ে গেছে। জ্ঞান নেই, অনিয়মিতভাবে হৃদস্পন্দন হচ্ছে- তাই মৃত বলা যাচ্ছে না। তেমন কিছু করার ব্যবস্থাও নেই এখানে। তবু যা কিছু করা সম্ভব ওঁরা দু’জনে করে যাচ্ছেন। অচেনা এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে অনেকটা ঘোরের মধ্যেই ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকি। নিজের হাত ব্যস্ত থাকায় একসময় আব্বা না মামা কে যেন আমাকে সিরাজের পাল্স দেখতে বললেন। আজও মনে আছে, বেশ কিছুটা সময় তাঁর একটা হাত দু’হাতে ধরে পাল্স গুনার চেষ্টা করেছিলাম। ক্ষীণ একটা স্পন্দন অনুভব করা যায়, দ্রুত বেড়ে ১৪০-১৫০ হয়ে যাচ্ছে, পরক্ষণেই কমতে কমতে ১০-২০ এ নেমে আসছে। বাড়ছে-কমছে, কিন্তু পুরোপুরি থেমে যাচ্ছে না। কী এক অদম্য জীবনীশক্তি! এভাবেই অতিবাহিত হতে থাকে বাংলার এক সূর্যসন্তানের জীবনের শেষ ক’টা প্রহর। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো খবর। নেতৃবৃন্দ আসছেন, সহযোদ্ধারা আসছেন- ভিড় বাড়তে থাকলো। সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ডাক্তার দু’জনের দিকে। আর কিছু কি করার নেই? বড়ছড়া থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার মেজর বাট এলেন। সে সময়টাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনও অফিসার না থাকায় সাব-সেক্টরের সামরিক কর্মকান্ড পরিচালনায় তখন সম্ভবত মেজর বাট-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সজ্জন তরুণ এই অফিসারের সাথে এই ক’মাসেই আব্বার চমৎকার বোঝাপড়া। হেলিকপ্টার আনিয়ে শিলং পাঠানো যায় কিনা- ডাক্তার হিসেবে আব্বার মতামত জানতে চাইলেন। তখন দেখলাম আব্বার এক ভিন্ন চেহারা। যে মানুষটি জাতীয় সঙ্গীত শুনলে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেন না, সেই তিনি ধীর স্থির কণ্ঠে যেন এক অলঙ্ঘ্য সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন- খবঃ যরস ফরব ঢ়বধপবভঁষষু রহ যরং ড়হি ংড়রষ। আমি ছোট মানুষ, বড়দের অনেক কথাই শুনিনি, তাঁদের সব ভূমিকাই হয়তো দেখিনি। কিন্তু যতটুকু দেখলাম- কী আশ্চর্য্য! আব্বার এই বক্তব্যের কোন দ্বিমত হলো না, ভিন্ন কোন প্রস্তাব উঠলো না! সহযোদ্ধার আসন্ন বিয়োগ ব্যথায় কোন মাতম হলো না! নীরবে শেষকৃত্যের প্রারম্ভিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। দুপুরের দিকে হার মেনে নিল সিরাজের জীবনীশক্তি। টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের প্রথম শহীদ হলেন সিরাজ। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা মো. সিরাজুল ইসলাম। পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হলো। অনেক মানুষ জানাজায় অংশ নিলেন। ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়েও মেজর বাটও ছিলেন জানাজার শেষ কাতারে। জাতীয় পতাকায় আবৃত মরদেহ জানাজা থেকে কবরে নেওয়ার পথে বি.এস.এফ-এর একটা দল রাইফেল উল্টো করে ধরে স্লো-মার্চ করে সঙ্গ দিলো, কবরে নামানোর আগে ২১ বার রাইফেলের ট্রিগার টেনে গান-স্যালুট দেয়া হলো। আর আমার আব্বা, ডা. মো. হারিছ উদ্দিন, জানাজা শেষে ঘরে বসে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে থাকলেন। আচ্ছা আব্বা, মেজর বাট যখন সিরাজকে শিলং নেওয়ার প্রসঙ্গে আপনাদের মতামত জানতে চাইলেন, ‘শিলং নিয়েও তাকে বাঁচানো যাবে না’ – আপনি তো এ’কথা বলেও আপনার অসম্মতি প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু তা না বলে মাতৃভূমিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের বিষয়টিকেই কেন গুরুত্ব দিলেন? নিজের দেশ, মাতৃভূমি এতোটাই মুখ্য আপনার কাছে?
আব্বা, আমার আরও কিছু জিজ্ঞাসা ছিল আপনার কাছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় আপনি সুনামগঞ্জ টি.বি. ক্লিনিকের মেডিকেল অফিসার ছিলেন। বরাবরই সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন মানুষ। হোমসিক্, নিজের এলাকাতেই থাকতে চেয়েছেন সবসময়। ক্যারিয়ার নিয়েও তেমন তাড়িত হননি কখনও। বড় তিন ছেলে মেয়ে স্কুলে পড়ে। পড়াশোনায় প্রত্যেকে ভাল, বরাবরই পরীক্ষায় প্রথম-দ্বিতীয় হয়। সুখ, সাচ্ছন্দ্য আর স্বস্তি মাখানো এক সংসার। রাজনীতি-সচেতন ছিলেন, কিন্তু সরকারি চাকুরিতে থেকে রাজনীতির ধারে কাছেও যাননি কোনদিন, কিংবা চাকুরিবিধির সামান্যতম ব্যত্যয়ও করেননি কখনও। পাকবাহিনী সুনামগঞ্জে এলে মার্চের শেষদিকেই কর্মস্থল ছেড়ে নিজবাড়ি তাহিরপুর থানার বড়দল গ্রামে চলে গেলেন। চাকুরিজীবী অনেকেই ২৬ মার্চের পর পাঁচ-দশদিন এদিক ওদিক সরে ছিলেন, কিন্তু পরে প্রায় সবাই যে যাঁর কাজে যোগ দেন। একটু আড়ষ্ট থাকলেও শহুরে জীবন ধীরে ধীরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। স্কুল-কলেজ চালু হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের সন্তানেরাও লেখা-পড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। তাহলে আপনি কেন ফিরে এলেন না? মে মাস থেকে মুক্তিযুদ্ধ ধীরে ধীরে গোছানো রূপ নিতে থাকলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র-জনতা অনেকেই যুদ্ধে যেতে থাকেন। এঁদের বেশিরভাগই ছিলেন বয়সে নবীন, দেশের ক্রান্তিকাল আর স্বজন হারনোর প্রতিশোধস্পৃহা তাঁদেরকে ঘরে বসে থাকতে দেয়নি। আপনার বয়সী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী অনেকেই গিয়েছিলেন তাঁদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন নিরাপত্তার কারণে। কিন্তু আপনি কেন? আপনার তো ভয়ের কোন কারণ ছিল না। চাকুরে হিসেবে যুদ্ধে যাওয়ার কোন বাধ্যবাধকতাও ছিল না, বরং চাকুরিবিধি অনুযায়ী কর্মস্থলে থাকাটাই কর্তব্য ছিল। শত শত সরকারি চিকিৎসকের মধ্যে ক’জনের পক্ষে তাঁদের চাকুরি-সংসার ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া সম্ভবপর হয়েছিল? অথচ আপনি নিলেন এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত! আজ আমি নিজেও সন্তানের পিতা, গৃহী মানুষ। কিন্তু ভেবে পাই না- কোন দায়িত্ববোধ আর প্রত্যয়ের কাছে তুচ্ছ, গৌণ হয়ে গিয়েছিল নিজের চাকুরির ধারাবাহিকতা, পরিবারের ভরণ-পোষণ, সন্তানদের পড়াশোনা – এসব জরুরি বিষয়গুলো! বিবেকের কোন অমোঘ তাড়না আপনাকে সেই অনিশ্চয়তার পথে চালিত করেছিল?
এসব প্রশ্নের উত্তর আর জানা হবেনা। চার বছর আগের আজকের এইদিনে (১০ জুন ২০১২ খ্রি.) আপনি চলে গেছেন লোকান্তরে। যেখান থেকে কোন প্রশ্নের জবাব দেয়া যায় না। আপনার নিকটজনদের মাঝেও তেমন কেউ আর বেঁচে নেই যাঁরা আপনার মতো সেই বোধের অধিকারী ছিলেন। কার কাছে পাব আপনাদের সেদিনের সেই সাহস আর প্রেরণার উৎসের ঠিকানা? কে খুলে দেবেন আপনাদের তখনকার মনোজগতের দুয়ার? আপনি যে যুদ্ধে ছিলেন, কত কত আহত যোদ্ধা আপনার হাত ধরে সুস্থ হয়ে আবার অপারেশনে গেছেন, যুদ্ধ শেষে বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁদের অনেকে আপনার কাছ থেকেই যুদ্ধাহতের প্রত্যয়নপত্র নিয়েছেন- সেসব কথাই হয়তো ক’দিন পরে আর কেউ জানবে না। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন আপনি ও আপনার মতো অনেকেই- যা কোনওভাবেই হতে দেয়া যায় না। আপনাদের অবদানের সে ইতিহাস সদা সমুজ্জ্বল রাখার দায়িত্ব জাতিকেই নিতে হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা নিজে কেন জাতির কাছে কিছু চাইতে যাবেন! জাগতিক কিছু পাওয়ার আশায় তো তাঁরা নিজের জীবনকে, নিজের আপাতঃ গোছানো ভবিষ্যৎকে তুচ্ছজ্ঞান করেননি! তাঁদেরকে কেন কিছু চেয়ে পেতে হবে। বরং জাতিরই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য- সাধ্য অনুযায়ী তাঁদের সাচ্ছন্দ্য বিধান করা, যাঁদের সে প্রয়োজন নেই তাঁদেরকে অন্তত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকু দেয়া। যে কারণেই হোক, সে সম্মান আর স্বীকৃতি ছাড়াই স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে আপনাকে চলে যেতে হলো। আশংকার বিষয়- আপনার মতো কেউ কেউ হয়তো আজও সে স্বীকৃতি পাননি, নিভৃতে জীবনের গোধূলিলগ্ন অতিক্রম করছেন, তাঁদেরকেও না এই অতৃপ্তি নিয়েই একদিন বিদায় নিতে হয়!
দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে সমাজ, যতটা না চেহারায় তারচে’ বেশি মননে। মানুষ এখন আর মানুষকে নিয়ে ভাবে না। অন্যের ভাল-মন্দ কিংবা পাশের জনের অধিকার- এই সামাজিক ইস্যুগুলো এখন আর ধর্তব্যের বিষয় নয়। নিজেকে নিয়েই তার সকল আয়োজন, নিজের প্রাপ্তি আর দখলের বিস্তৃতি বাড়াতেই তার সকল কর্মযজ্ঞ। ন্যায়-অন্যায়, দায়িত্ব আর অধিকার ইত্যাদির ফারাক দিনে দিনে অস্পষ্ট আর অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাচ্ছে। এখন নিজের ঢোল নিজেকেই বাজাতে হয়। নিজের ন্যায্য পাওনার জন্য প্রকাশ্যে-আড়ালে নিজেকেই ছুটোছুটি করতে হয়। আজকের সমাজে এটাই নিয়ম। আপনি এই নিয়মের সাথে তাল মেলাতে পারেননি, তাই জীবদ্দশায় আপনার প্রাপ্যটুকুও পাননি। খুবই সহজ হিসাব।
শুনেছি সিদ্ধান্ত হয়েছে- মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য অনলাইনে করা আবেদন স্থানীয় পর্যায়ের ইউনিট কমান্ড যাচাই-বাছাই করবেন, যাচাই-বাছাইপর্ব শেষে তাঁদের মতামত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠাবেন। তারপর জাতীয় কাউন্সিল সন্তুষ্ট হলে সময় সুযোগ করে একজন মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ঘোষণা করবেন, গ্যাজেট নোটিফিকেশন হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখছি- বড্ড ধীর সে প্রক্রিয়া। আর ভয়টা সেখানেই। মুক্তিযুদ্ধে আপনার ভূমিকা প্রত্যক্ষ করেছেন এমন সহযোদ্ধাই হয়তো ক’দিন পরে স্থানীয় ইউনিট কমান্ডে আর কেউ থাকবেন না, যাঁরা যাচাই করে বলতে পারতেন- হ্যাঁ, এই ভদ্রলোককে আমরা চিনি, জানি। তিনি ডা. মো. হারিছ উদ্দিন। ৫নং সেক্টরের অধীন টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে তিনি মেডিকেল অফিসার ছিলেন। আমরা অনেকেই আহত হয়ে, অসুস্থ হয়ে তাঁর চিকিৎসা নিয়েছি, তাঁর সেবা নিয়েছি। সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই মুক্ত করেছি, সুনামগঞ্জ মুক্ত করেছি। ১৬ ডিসেম্বর জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছি। আমাদেরকে সুস্থ আর কর্মক্ষম রাখার মাধ্যমে এই মহান অর্জনে তাই এই মানুষটিরও কিছুটা অবদান ছিল।’ ব্যাস এটুকুই। এর বেশি কিছু নয়। এই সহজ সত্য কথাগুলো ব্যক্ত হোক, যথাযথ দাপ্তরিক স্বীকৃতি পাক- তাঁর সন্তান হিসেবে এটুকুই আমাদের প্রত্যাশা। বস্তুগত কিছু প্রাপ্তির লোভে নয়, একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান আর গৌরবটুকু ধারণ করে, প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত করার তাগিদেই এই প্রত্যাশা। যে আত্মসম্মানবোধ দেশ-মাতৃকার স্বার্থে আগামী প্রজন্মকে সদা আপোষহীন থাকার শক্তি জোগাবে। যে গৌরব প্রেরণা হয়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে ব্যক্তিগত সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করতে শেখাবে।
এই উপলব্ধির মাঝেই হয়তো মিশে আছে আমার ব্যক্তিগত সব জিজ্ঞাসার জবাব।
আব্বা, জীবিত থাকলে এই লেখাটা পড়ে কি আপনার খুব অস্বস্তি হতো? প্রকারান্তরে নিজের জন্যে কিছু চাওয়া হয়ে যাচ্ছে ভেবে বরাবরের মতোই কি খুব বিব্রতবোধ করতেন?
[লেখক : একজন চিকিৎসক]