শামস শামীম ::
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ‘আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা বেহাল। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারি পরিচালক বরাবরে জেলা শিক্ষা অফিস কর্তৃক প্রেরিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জেলার ১১টি উপজেলার ৫৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত’। ‘উপজেলা ভিত্তিক অন্যূন ৩-৬ অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়’ শিরোনামে পাঠানো প্রতিবেদনে প্রতিটি উপজেলায় ৫টি করে বিদ্যালয়ের নাম দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়ের সংখ্যা অন্তত ৫ শতাধিক হবে।
সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্মিত বিদ্যালয় ভবন নির্মাণে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্টদের সংশ্লিষ্টতা না থাকায় ঠিকাদাররা নি¤œমানের কাজ করছেন। ফলে কয়েক বছর যেতে না যেতেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়া, মেঝে দেবে যাওয়া, দরোজা-জানালা ভেঙ্গে যাওয়াসহ বিদ্যালয় ভবনে নানা সমস্যা দেখা দেয়।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আহ্বানের প্রেক্ষিতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় গত বছরের ২ আগস্ট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারি পরিচালক বরাবরে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। ওই প্রতিবেদনে ৫৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনকে ‘অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে তারা উল্লেখ করেন।
সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে ‘অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত’ সদর উপজেলার বিদ্যালয়গুলো হলো- জগজীবনপুর, হোছনপুর, মঙ্গলকাটা, শাহপুর ও বল্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দোয়ারাবাজার উপজেলার আকিলপুর, সোনাপুর, বেরী, যাদুকাটা ও এরুয়াখাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বিশ্বম্ভখরপুর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফতেপুর-নোওয়াগাঁও, বালারগাঁও, পান্ডামারা, উপজেলা সদর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছাতক উপজেলার নোওয়াগাঁও, পীরপুর, বারকাহন, কোনবাড়ি ও চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তাহিরপুর উপজেলার ইউনুছপুর, নোয়াবন্দ, পাকাবিতিওর জালাল প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুক্তিয়ারগাঁও ও শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জামালগঞ্জের হটামারা, কান্দিগাঁও, পশ্চিম মদনাকন্দি, শান্তিপুর, পশ্চিম রাজারপুর, ধর্মপাশা উপজেলার দুর্গাপুর, ঘাসী, শান্তিপুর, বানারশিপুর ও নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মির্জাকান্দা, হাটি ইয়ারাবাদ, গুয্যানি, জাতগাঁও, মুক্তারপুর ও বাহারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; দিরাই উপজেলার এলংজুড়ি, দত্তগ্রাম, চন্দপুর, বাউশি ও কেজাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; জগন্নাথপুর উপজেলার বাগময়না, বারকাপন, মিরপুর মহল্লা, জয়নগর ও হিজলা নাদামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস, মড়মোহা, পার্বতীপুর, তেঘরিয়া এবং দামোধরতপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
জানা গেছে, প্রতিবেদনে এসব বিদ্যালয় সংস্কারের বদলে নতুন করে নির্মাণের পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। তবে এখনো এ বিষয়ে অধিদপ্তর কিছু জানায়নি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয় সংস্কারে সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, তাহিরপুর উপজেলার রতনশ্রী পূর্বপাড়া, রতনশ্রী, বড়দল নতুন হাটি, উক্তিয়ার গাঁওসহ ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ এবং দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার হাওর বেষ্টিত গ্রামগুলোর অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদ এবং মেঝেতে গর্ত রয়েছে। তাছাড়া দরোজা-জানালাও ভাঙ্গা। ২০০৯ সালে নির্মিত সদর উপজেলার নারাইনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও বেহাল। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নি¤œমানের কাজ করায় দুই বছর পরই দরোজা, জানালা ভেঙে গেছে। ভবনের অবস্থাও বেহাল।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঠিকাদাররা নামকাওয়াস্তে কাজ করায় বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা বেহাল বলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান। জানা গেছে, ২০১৪ সালে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের জনৈক প্রতিনিধি বিভাগীয় সম্মেলনে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে এলজিইডি’র ঠিকাদাররা যাচ্ছেতাই কাজ করে বলে অভিযোগ করেন। প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় কয়েক বছর যেতে না যেতেই ভবনে সমস্যা দেখা দেয় বলে ওই কর্মকর্তা অভিযোগ করেন।
তাহিরপুর রতনশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কুলন চক্রবর্তী বলেন, আমার বিদ্যালয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। নব্বই দশকের শেষ দিকে নির্মিত ভবনটির উপর দিয়ে পানি পড়ে। দরোজা-জানালা ভাঙা। পুরো বিদ্যালয়ের মেঝের মাটি সরে গেছে বহুদিন আগে। বারবার এই দুরাবস্থার কথা লেখার পরও সংস্কার কাজ হচ্ছে না।
সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সোলেমান মিয়া বলেন, নির্মাণ ত্রুটির জন্য সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের অবস্থা ভঙ্গুর। প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ না করায় কয়েক বছরের মধ্যেই দরোজা জানালা ভেঙে গেছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. হযরত আলী বলেন, অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ৫৫টি বিদ্যালয় নতুন করে নির্মাণের জন্য আমরা অধিদপ্তর বরাবর প্রতিবেদন দিয়েছি। এসব বিদ্যালয় নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। তবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজে জবাবদিহিতা আনতে হবে। যাতে বিদ্যালয় নির্মাণের কয়েক বছরের মাথায় বেহাল অবস্থায় না দাঁড়ায়।