তৈয়বুর রহমান ::
মানব জীবন নশ্বর। তবুও কেউ তাদের সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে রচনা করেন জীবনের নতুন ইতিহাস; তাঁরা বেঁচে থাকেন হাজারো মানুষের হৃদয়পটে। মানব সংস্পর্শে এসব জীবন হয়ে উঠে নন্দিত, মহিয়ান এবং কালোজয়ী। এরকম মানুষের জীবনাদর্শ মানব সভ্যতাকে সুশীল ও বেগবান করে তুলে। সমাজ পরিবর্তনে এমন একটি আদর্শ পালন করে অগ্রণী ভূমিকা। আজ এমন একজন সৈনিকের কথা তুলে ধরছি যিনি বাংলা সাহিত্য তথা আমাদের জীবনে সাম্যবাদ চর্চায় যোগ করেন নতুন মাত্রা। আমাদের সাহিত্যে বেগবান হয়ে ওঠে সাম্যবাদী চর্চা। তিনি হলেন আমাদের প্রিয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এছাড়াও তাঁর রয়েছেন ভিন্ন পরিচয়; তিনি প্রেমের কবি, মানবতার কবি, যৌবনের কবি ও তারুণ্যের কবি। মূলত বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের সূচনা হয়েছিল। তাঁর এই বিদ্রোহ ছিল সমাজে বিদ্যমান সকল অন্যায়, অসত্য, শাসন ও শোষণ এবং অবিচারের বিরুদ্ধে। বাংলা সহিত্যে তাঁর আগমন ছিল যেন আকাশে উদিত ধূমকেতুর মতই। তিনি কলুষিত ও অসম-প্রথাগত সমাজকে ভেঙে নতুন এক সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সুষ্ঠুধারার এমন একটি সমাজ যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য এবং মৈত্রীতার মেলবন্ধনই হবে সমাজে বসবাসের প্রধান শর্ত। এজন্য কবি নজরুল ইসলামকে সাম্যবাদী অভিধায়ও ভূষিত করা হয়; তিনি সাম্যবাদী কবি, মানবতার কবি। তাঁর অন্য পরিচয়ের চেয়ে এই পরিচয় ব্যাখ্যা করে কবি নজরুলের সাম্যবাদী পরিচয়। বস্তুত সাম্যবাদী এই কবি বাঙালি জাতিকে শোষণ ও পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছিলেন-
‘ওরে লাল শিয়ালের দল
এদেশ ছাড়বে কিনা বল
নইলে তোদের কিলের ছুটে
হাড় করিব জল’
কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। শতসহ¯্র কণ্টকাকীর্ণ বাধা-বিপত্তি থামাতে পারেনি তাঁর লেখালেখি। দারিদ্র্যের কালো থাবা ও যাঁতাকল তাকে তাঁর সাহিত্য সাধনা থেকে বিন্দু পরিমাণও নড়াতে পারেনি । দৃঢ় প্রত্যয়ী ও অনড় এ কবি নারী-পুরুষের সমতা বিধানকেও উদ্দিষ্ট করে কবিতা রচনা করেছেন:
‘পৃথিবীতে যাহা সত্য চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/অর্ধেক তার নর’।
আসলে কবি নজরুল ইসলাম ধর্মের চেয়ে মানুষকে প্রাধান্য দিতে দ্বিধা করেন নি। কেননা পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। তখন মানুষ কোন ধর্মের, কোন বর্ণের বা কোন জাতের সেটা তত বড় নয়। কবি সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ‘মানুষ’ কবিতায় বলেছেন:
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহিয়ান’
আমাদের এই প্রিয় কবি ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে, ২৪ শে মে, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজী ফকির আহমদ মা জাহেদা খাতুন। মাত্র আট ৮ বৎসর বয়সে পিতৃহীন হয়ে চরম আর্থিক অনটনের মধ্যেই কাটে তাঁর বাল্যজীবন। নজরুলের জন্মের পূর্বে তার একাধিক ভাই-বোন মারা যান। তাই ছোটবেলায় মা-বাবা তাকে দুুখু মিয়া বলে ডাকতেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর অর্থ উপার্জনের জন্য মাজারে খাদেমগিরি ইমামতি ও মোল্লাগিরি করেন। অল্প বয়সে কবিত্বশক্তির প্রকাশ হলে তিনি লেটোগানের দলে যোগ দেন। নজরুল গান গেয়েছেন পালাগান রচনা করেছেন। লেখাপড়ায় ভালো হলেও মনোযোগী ছিলেন না। অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি রুটির দোকানে কাজ করেন। রুটির দোকানে কাজের ফাঁকে মধুর সুরে গান গাইতেনও তিনি। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে আসানসোলের দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহ নিজ বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুরের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তিনি স্কুল ফাঁকি দিয়ে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে চলে যান করাচি শহরে। সেনা শিবিরে ব্যস্ততার মাঝেও চলে তাঁর সাহিত্যচর্চা। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ব্যথার দান ও কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা। আর এভাবেই বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয় শিখা, চক্রবাক, সিন্দুহিন্দোল প্রভৃতি। নজরুল রচিত গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে রিক্তের বেদন, শিউলি মালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবি নজরুল ইসলাম গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র মাত্র চল্লিশ বৎসর বয়সে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। অনেক চিকিৎসার পরও তাকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালে ২৪ শে মে কবিকে কলকাতা থেকে এদেশে আনা হয়। এ সময় কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। অবশেষে কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট ঢাকার পি.জি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই ইহধাম ত্যাগ করেন। কবির ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের মধ্যে গণমানুষের ও সাম্যবাদী কবি নজরুল চিরকাল বেঁচে থাকবেন। আজ কবির ১১৭তম জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
[লেখক : শিক্ষার্থী, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ।]