শামস শামীম ::
সরকার বোরো ধানের প্রতি মণ ৯২০ টাকা নির্ধারণ করায় উজানীগাঁও গ্রামের কৃষক পলিম মিয়া খুশি হয়েছিলেন। সরকারি এই ঘোষণায় এবার খাদ্যগুদামে ধান দেওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সরকারি ঘোষণার ১৫দিনের অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও ধান সংগ্রহ শুরু না হওয়ায় বাধ্য হয়ে সাংসারিক প্রয়োজনে এই কৃষক ‘পাইকার’ এর কাছে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন মাত্র ৫৫০ টাকা মণ দরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষক পলিম মিয়ার মতো অবস্থা অন্য কৃষকদেরও। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কেউ ধান দিতে পারছেন না। ফলে কৃষকের কষ্টে ফলানো ধান চলে গেছে ফড়িয়ার হাতে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছরই সুনামগঞ্জের সরকারি ঘোষণাকে তেমনটা তোয়াক্কা করেনা খাদ্য বিভাগ। তাদের মতো একই অবস্থা কৃষি বিভাগেরও। নির্ধারিত সময়ে কৃষকদের তালিকা চূড়ান্ত না করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। ফলে কৃষকদের লাভবানের বদলে মুনাফা লুটছে কিছু মধ্যস্বত্তভোগী ও ফড়িয়া সিন্ডিকেট। অনেক কৃষকের অভিযোগ নানা কাঠখড় পুড়িয়ে গুদামে ধান দিতে এসে তাঁরা ধানের গুণাগুণ বিচারের নামে খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টদের হয়রানির শিকার হন। ফলে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে গুদামে ধান দিতে চাননা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো সব উপজেলা থেকে কৃষকের তালিকা পাওয়া যায়নি। জেলা সংগ্রহ কমিটির সভা হলেও অনেক উপজেলায় এখনো সংগ্রহ কমিটির সভা হয়নি। তাছাড়া কৃষি বিভাগও ধান দিতে আগ্রহী কৃষকদের তালিকা যথাসময়ে দিতে না পারায় কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। জানা গেছে, এ পর্যন্ত মাত্র দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের কৃষকের তালিকা হাতে পেয়েছে খাদ্য বিভাগ। বাকি ৮ উপজেলার তালিকা এখনো প্রস্তুতই হয়নি বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে- ব্লক সুপার ভাইজাররা সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থান না করায় তালিকা তৈরিতে বিলম্ব হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জানান, কৃষকের কাছে ধান সংগ্রহ করার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে কৃষকরা সহজে ধান দিতে পারেন না। তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে একশ্রেণির মধ্যস্বত্তভোগীরা ধান দেয় গুদামে। এবারও বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকের নাম সংগ্রহ করে তাদের নামে ব্যাংকে একাউন্ট করে ধান দেওয়ার তৎপরতা শুরু করেছে ওই সিন্ডিকেট। জানা গেছে, কৃষকের বদলে ওই ফড়িয়ারাই এখন খাদ্য বিভাগকে ধান দিতে আগ্রহী কৃষকদের তালিকা সরবরাহ করছে। কৃষকদের ঠকিয়ে তারা মুনাফা লুটে নিচ্ছে বলে জনপ্রতিনিধিরা জানান।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মওসুমে সুনামগঞ্জ জেলায় ৩০ হাজার ৯৭৯ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হবে। সদর উপজেলায় ২ হাজার ১৭৬ মে. টন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ৩ হাজার ১০৫ টন, দোয়ারাবাজারে ১ হাজার ৯৩৬ টন, ছাতকে ১ হাজার ৭৪৯ টন, জগন্নাথপুরে ২ হাজার ৮৬১ টন, দিরাইয়ে ৪ হাজার ১৪০ টন, শাল্লায় ৩ হাজার ৪০০ টন, ধর্মপাশায় ৪ হাজার ২৬২ টন, জামালগঞ্জে ৩ হাজার ৫৫৩ টন, তাহিরপুরে ২ হাজার ৩৯৮ টন এবং বিশ্বম্ভরপুরে ১ হাজার ৩৯৯ টন ধান সংগ্রহ করার কথা। এ পর্যন্ত শুধু তাহিরপুর উপজেলায় খাদ্য বিভাগ ধান সংগ্রহ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের আসামপুর গ্রামের কৃষক নেতা এনামুল কবির বলেন, আমার এলাকার অনেক কৃষক সরকারি খাদ্যগুদামে ধান দিতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু প্রয়োজনের সময় গুদামে ধান দিতে না পেরে তারা পাইকারদের কাছে সরকার নির্ধারিত অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন কৃষকের ধান ফড়িয়া সিন্ডিকেটের হাতে। তারা ওই কৃষকের নাম ব্যবহার করেই সরকার নির্ধারিত মূল্যে গুদামে ধান দিয়ে মুনাফা লোটে নেবে। তিনি বলেন, সরকারকে কখনোই ধান দিতে পারেনা কৃষকরা। নানা কাঠখড় পুড়িয়ে তারা ধান দিতে এলে খাদ্য বিভাগ ধানের গুণাগুণ ভালো নয় বলে তাদের হয়রানি করে। অথচ ফড়িয়াদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তারা এই ধানই সহজে গুদামে ঢুকাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, সব উপজেলা থেকে এখনো কৃষকের তালিকা পাওয়া যায়নি। যে গুলা থেকে পাওয়া গেছে সেগুলোর তালিকা খাদ্য বিভাগকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নঈম মোহাম্মদ শফিউল আলমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি। তবে গত সপ্তাহে এই প্রতিবেদককে তিনি জানিয়েছিলেন, জেলা সংগ্রহ কমিটির সভা শেষে সব উপজেলায় সভা করে দ্রুত ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া কৃষি বিভাগের কাছ থেকে যথাসময়ে তালিকা না পাওয়ার কারণেও ধান সংগ্রহে কিছুটা বিলম্বের কথা স্বীকার করেন তিনি।