স্টাফ রিপোর্টার ::
আজ ভয়াল ১১ মে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের ছায়াঘেরা গ্রাম তেঘরিয়ার বয়স্ক মানুষ এ দিনটি এলে এখনো ভয়ে কুকড়ে যান। ওইদিন স্থানীয় সাত্তার রাজাকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গ্রামে নিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ শেষে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান গ্রামের সাতজন মানুষ।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকরা জানান, সত্তরের নির্বাচনে তেঘরিয়া গ্রামের মানুষ নৌকার পক্ষে ভূমিধস রায় দেয়। এতে ক্ষিপ্ত ছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালরা। তারা গ্রামবাসীকে শায়েস্তা করতে মনে মনে ফন্দি ফিকির করছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে উজানিগাঁও গ্রামের রাজাকার আব্দুস সাত্তার এলাকার চিহ্নিত চোর-ডাকাত, জেল পলাতক দাগী আসামিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী একটি শক্তিশালী ‘বাহিনী’ গড়ে তোলে। সাত্তারের নেতৃত্বেই ওই বিশেষ বাহিনী এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে লুটতরাজ চালায়।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সাত্তারের দালালের বাহিনী লুটতরাজের কৌশল হিসেবে ‘পাঞ্জাবীরা আসছে’ এই গুজব ছড়িয়ে তেঘরিয়া গ্রামে ঢুকে লুটতরাজ চালায়। প্রাণভয়ে গ্রামবাসী যে যেদিকে পারেন সেদিকে পালিয়ে যান। শূন্য গ্রামে সুযোগ পেয়ে ফাঁকা ঘর-বাড়িতে সাত্তার বাহিনীর লোকেরা লুট করে ঘরের মূল্যবান জিনিস নিয়ে যায়। এ সংবাদ সুনামগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে পৌঁছলে নেতৃবৃন্দ সাত্তার বাহিনীকে শায়েস্তা করতে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে দায়িত্ব দেন। চতুর সাত্তার এই সংবাদ পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।
১০ মে পাকিস্তানি খানসেনাদের সমরাস্ত্র সজ্জিত শক্তিশালী একটি দল সুনামগঞ্জে আসে। তাদের গাইড করে সুনামগঞ্জ নিয়ে আসে দালাল ফারুক চৌধুরী। এ সুযোগে অন্য দালালরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এসময় কুখ্যাত দালাল সাত্তারের অনুরোধে বিপুল সমরাস্ত্রসহ পাকিস্তানি হানাদারদের একটি বাহিনীকে সাত্তার দালালের বিশেষ বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য রেখে যায়। রাজাকার সাত্তার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের রেখে যাওয়া বাহিনী তেঘরিয়া গ্রামে প্রবেশ করে। এই খবরে গ্রামের পুরুষেরা পালিয়ে যান। বাড়িঘর ফাকা পেয়ে সাত্তার বাহিনী গ্রামবাসীর ঘরে ঘরে ঢুকে লুটে নেয় নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, আসবাবপত্র নানা জিনিষ। লুট করে তারা চলে আসে।
গ্রামে লুতটরাজ চালিয়ে আসার পর নিরীহ গ্রামবাসী মনে করেছিলেন জিনিস-পত্র ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ায় হয়তো হায়েনারা আর আসবেনা। কিন্তু কৌশলী পাকিস্তানি ও স্থানীয় দালাল বাহিনী গ্রামবাসীর চোখে ধোঁকা দিয়ে ১১ মে ফের গ্রামে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে প্রবেশ করে। নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে নির্যাতন শুরু করে। নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়ার ‘অপরাধে’ গ্রামবাসীর ওপর নির্যাতন করছে বলে এসময় তারা গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে খিস্তিখেউর করে এবং আগামীতে নৌকাপ্রতীকে ভোট দিলে আরো কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে গ্রামবাসীকে শাসাতে থাকে।
ওইদিন পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের দোসররা গ্রামের অর্ধ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। গ্রামের বিত্তবান ব্যক্তিত্ব দেবেন্দ্র তালুকদারের সুন্দর স্থাপত্যশৈলির বাড়িটিও গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
তেঘরিয়া গ্রামের রাবণ দাসের ছেলে রবীন্দ্র কুমার তালুকদারকে বসতঘরের ছাদ থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে তার দেহ ছেড়ে দেয়। ওইদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত গ্রামে পাক হায়েনা ও সাত্তার বাহিনী গ্রামে তান্ডবলীলা চালায়। ওইদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা গ্রামের গয়ানাথ দাস, উমেশ চন্দ্র দাস, নন্দুরাম দাস, ক্ষেত্রময়ী দাস, বৈদ্যনাথ দাস ও উপেন্দ্র দাসকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
একাত্তরের ক্ষতচিহ্ন এখনো বহন করছে গ্রামটি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও গ্রামে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে কোন স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। শহীদদের কথা এবং গ্রামে নির্মমতার কথা জানেনা নতুন প্রজন্ম। অবিলম্বে গ্রামবাসী ও নতুন প্রজন্ম গ্রামটিতে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।
সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, তেঘরিয়া গ্রামে গণহত্যার বিষয়টি এখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনালোকিত রয়ে গেছে। গ্রামের প্রবীণরা দিনটির ভয়াবহতার কথা এখনো স্মরণ করলেও নতুন প্রজন্ম জানেনা একাত্তরে গ্রামবাসীর উপর চালানো নারকীয়কতার কথা। শহীদদের স্মরণে জরুরি ভিত্তিতে এই গ্রামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ জরুরি।