শামস শামীম ::
হাওরে কৃষির বাম্পার ফলন, ক্ষয়ক্ষতি, সমস্যা-সম্ভাবনাসহ সার্বিক অবস্থার মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন কর্মএলাকা থেকে সরেজমিন প্রস্তুত করার কথা থাকলেও সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের কর্মীরা ঘরে বসে বাস্তবতাবর্জিত রিপোর্ট তৈরি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকার কৃষকের সঙ্গে উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তাদের সম্পর্কই নেই! কৃষকরা চিনেননা মাঠ পর্যায়ের কৃষি বিভাগের দায়িত্বরত কর্মীদের। চলতি মওসুমে পাহাড়ি ঢলে জেলার হাওরের অর্ধেকেরও বেশি ফসল সম্পূর্ণ তলিয়ে গিয়ে কৃষকরা বিরাট ক্ষতির মুখে পড়লেও ফসলহারা কৃষকের আর্তনাদ দেখছেনা কৃষি বিভাগ। বরাবরের মতো এবারও তারা ঘরে বসে হাওরের ক্ষয়-ক্ষতির মনগড়া রিপোর্ট সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠিয়েছে। হাওরের ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত চিত্র গোপন করায় কৃষক, জনপ্রতিনধিসহ সুধী সমাজের তোপের মুখে পড়েছে কৃষি বিভাগ। তারা কৃষি বিভাগের মিথ্যা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চলতি মওসুমে পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে, বাঁধ উপচে, জলাবদ্ধতা এবং শিলাবৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের ১০টি উপজেলায় প্রায় ১৫শ কোটি টাকার বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বৈশাখের শুরুতে ধান পাকার আগেই ফসলহানি হয়েছে বড় বড় হাওরে। কেবল জামালগঞ্জ উপজেলা ছাড়া সব উপজেলার হাওরের গড়ে অর্ধেক ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ মাত্র ৫শ কোটি টাকার বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছে। গত ৩ মে ঢাকার খামারবাড়ি কৃষি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো ক্ষয়-ক্ষতির প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়। ফসলের ক্ষতির কারণ হিসেবে ফসলরক্ষা বাঁধ ভাঙা, অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা এবং শিলাবৃষ্টিকে উল্লেখ করা হয়। গত ৯ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত এই ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া গত বছরও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেখিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই বছর দিরাই, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ এবং জামালগঞ্জে প্রায় অর্ধেক ফসলের ক্ষতি হলেও কৃষি বিভাগ গত বছর মাত্র ২২৯ কোটি ২৮ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। এর আগে ২০১০ সালে জেলার সকল হাওরের প্রায় ৮০ ভাগ ফসলের ক্ষতি হলেও কৃষি বিভাগ ওই সময় মাত্র ১১শ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয় বলে সরকারকে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। এভাবে প্রতি বছরই ফসলহানির প্রকৃত চিত্র সরকারের কাছে পৌঁছেনা। এ কারণে সরকার হাওরের কৃষকের জন্য বিশেষ সহায়তা দেয়না বলে কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ।
জানা গেছে, গত ২৪ এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংবাদ সম্মেলন করে উপজেলার ১৫ হাওরের ১৫০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন কৃষি বিভাগ ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র কমিয়ে দেখিয়ে বাস্তবতাবর্জিত রিপোর্ট তৈরি করে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এতে ফসলহারা কৃষকরা ক্ষতিপূরণ পাবেননা বলে আশঙ্কা করেন।
গত ১৩ এপ্রিল স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলো শহরের আলফাত স্কয়ারে বোরো ফসলহারা কৃষকদের পুনর্বাসনের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সমাবেশে কৃষক নেতারা অভিযোগ করেন কৃষি বিভাগের কর্মীরা মাঠে না গিয়েই ঘরে বসে মনগড়া প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের রিপোর্ট সম্পূর্ণ মিথ্যা। এবার বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর বরাবরের মতো কৃষি বিভাগ হাওরের বোরো ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত তথ্য আড়াল করে মনগড়া আংশিক রিপোর্ট করেছে বলে অভিযোগ করেন।
গত ২৮ এপ্রিল স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলো শহরে হাওরের বোরো ফসলহারা কৃষকের পুনর্বাবসন এবং ফসল রক্ষায় স্থায়ী সমাধানের দাবিতে মতবিনিময় সভা করেন। মতবিনিময় সভায় কৃষক নেতারা কৃষি বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। বক্তারা বলেন, কৃষি বিভাগ ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আড়াল করে খন্ডিত রিপোর্ট তৈরি করায় হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতিপূরণ পান না।
এদিকে গত ২৫ এপ্রিল জেলা উন্নয়ন সমন্বয়সভায়ও কৃষি বিভাগের বিরুদ্ধে হাওরের বোরো ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য গোপনের অভিযোগ আনেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এভাবে মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করায় কৃষি বিভাগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফোরামেই অভিযোগ আনছেন কৃষকরা। কৃষক নেতারা জানান, স্থানীয় কৃষকরা ঐতিহ্যগত জ্ঞানের মাধ্যমেই নিজস্ব পদ্ধতিতে চাষবাস করেন। এসব কাজে কৃষি বিভাগের কোন পরামর্শ পাননা তাঁরা। প্রতি বছর কৃষি বিভাগ বোরো মওসুমে চাষের ও উৎপাদন যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। তারা ঘরে বসেই আগের বছরের রিপোর্টকে সামনে রেখে প্রতি বছর একটু এদিক সেদিক করে প্রতিবেদন তৈরি করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র মতে এবার ২ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছিলা। এর মধ্যে শিলাবৃষ্টিতে ৪ হাজার ২১৭ হেক্টর, পাহাড়ি ঢলে, অতিবর্ষণ এবং বাঁধ ভেঙে প্রায় ৩৮ হাজার ২৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অংকে শিলাবৃষ্টিতে ৫১ কোটি এবং পাহাড়ি ঢলে ৪৬২ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের মতে এবার মোট চাষের প্রায় অর্ধেক জমি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫শ কোটি টাকা।
কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, তাহিরপুরের শনির হাওরের প্রায় ৯০ ভাগ এবং সদর উপজেলার দেখার হাওরের প্রায় ৭০ ভাগ জমির ফসল তলিয়েছে। কিন্তু কৃষি বিভাগের প্রতিবেদনে তাহিরপুরে ৪০ ভাগ এবং দেখার হাওরে মাত্র ৩০ ভাগ ফসলের ক্ষতির কথা স্বীকার করা হয়েছে।
জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ বলেন, বৈশাখের শুরুতেই হাওরের অর্ধেক জমির ধান শিলাবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢলে নষ্ট হয়েছে। কৃষি বিভাগ ক্ষতির ভুয়া রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এতে হাওরের প্রকৃত ক্ষতির চিত্রকে আড়াল করা হয়েছে। এ কারণে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে। এই জনপ্রতিনিধি বলেন, কৃষি বিভাগের যেসব কর্মী মাঠে গিয়ে কৃষির সার্বিক চিত্রের খোঁজ খবর নেওয়ার কথা তাদের কাউকে কৃষকরা চিনেনা। কে কোন এলাকায় দায়িত্ব পালন করে জানেনা কেউ।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, তাহিরপুরে ১৫ হাওরের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ফসল এবার নষ্ট হয়েছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ ক্ষতি নিয়ে লুকোচুরি করেছে। ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত প্রতিবেদন তারা না পাঠিয়ে ঘরে বসে মনগড়া রিপোর্ট পাঠিয়েছে। আমি জেলা উন্নয়ন সমন্বয়সভায়ও এ বিষয়ে কথা বলেছি। কৃষি বিভাগ ক্ষতি কমিয়ে দেখানোয় কৃষকরা বিশেষ সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, আমাদের কর্মীরা মাঠে গিয়েই প্রতিটি মওসুমে প্রকৃত রিপোর্ট তৈরি করে। তবে জনবল সংকটের কারণে কাজ করতে সমস্যা হয় বলে তিনি জানান। যেসব কর্মীরা মাঠে যায়না অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।