সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছেন আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবীর করা একটি রিট আবেদনে দেওয়া রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ বৃহ¯পতিবার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এই রায় দেয়।
রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন।
রায়ের পর তিনি বলেন, “আমরা এই রায় স্থগিতের জন্য রোববারই চেম্বার আদালতে আবেদন করব।”
উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
অসদাচরণের জন্য উচ্চ আদালতের কোনো বিচারককে কীভাবে অপসারণ করা যাবে, সে প্রক্রিয়া নির্ধারণে আরেকটি আইনের খসড়ায় ইতোমধ্যে সম্মতি দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৫ নভেম্বর হাই কোর্টে এই রিট আবেদন হয়। প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, আইন সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এই রুলের উপর গত বছর ২১ মে শুনানি শুরু হয়। ওইদিন আদালত মতামত দিতে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ পাঁচ আইনজীবীর নাম ঘোষণা করেন।
এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি এই শুনানিতে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
১৭ দিন শুনানির পর গত ১০ মার্চ আদালত এ বিষয়ে রায়ের দিন ঠিক করে দিয়েছিল। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও রিট আবেদনকারী পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন।
রুলের ওপর শুনানিতে আদালতের পরামর্শদাতা (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে দেওয়া মতামতে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্যতম অংশ। জাতীয় সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে। তাই এই সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি গণ্য করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেছিলেন, বিচারপতিদের অপসারণের প্রক্রিয়া আগে ছিল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে। ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সংসদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি এই অপসারণ করবেন। আর সংসদ তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে সুপারিশ দেবে।
ওই তদন্ত কমিটি কীভাবে গঠিত হবে সে বিষয়ে একটি বিল এখন পর্যন্ত বিবেচনাধীন জানিয়ে তিনি শুনানিতে বলেন, “এটি আইনে পরিণত হলেই কিন্তু এ বিষয়ে কারণ (কজ অব অ্যাকশন) উদ্ভব হবে। কাজেই আমার বক্তব্য হল, জনস্বার্থ মামলা হিসেবে যারা মামলাটি করেছেন- তাদের মামলা করার সময় আসেনি।
“আইন হওয়ার পরে আইনে যদি কোনো রকম ব্যত্যয় হয়, দেখা যায় সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক- তখনই কারণ উদ্ভব ঘটবে এটা চ্যালেঞ্জ করার।” এ কারণে রিট আবেদনটি ‘মেনটেইনেবল না’ (গ্রহণযোগ্য নয়) বলে যুক্তি দেখান তিনি।
অন্যদিকে রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে বলেছিলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারকের অপসারণের বিধানটি ছিল। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে আপিল বিভাগও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওই বিধানটি সুরক্ষা দিয়েছিল। এই সুরক্ষার পর পঞ্চদশ সংশোধনী যখন পাস হয়, তখন সংসদ ওই ৯৬ অনুচ্ছদকে সংরক্ষিত করেছিল।
“হঠাৎ করে কিছুদিন পরে ৯৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে এই ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পরিবর্তন হয়েছে সংবিধানের মৌল কাঠামোকে পরিবর্তন করে। কারণ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে থাকা ৭(বি) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে মৌল কাঠামো পরিবর্তন করা যাবে না।”
আনোয়ার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল কাঠামো। যেহেতু ‘মূল কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে’, সেহেতু ষোড়শ সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থি।
“এই ক্ষমতাটা যদি সংসদের হাতে দেওয়া হয়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ হতে পারে। তাই এই ক্ষমতাটা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়াটা যৌক্তিক হবে না।”