1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:৪৬ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

পাকা ধান তলিয়ে যায় : হাওরে আসে না ভাগালু

  • আপডেট সময় রবিবার, ১ মে, ২০১৬

শামস শামীম ::
হাওরে শ্রমমূল্য হিসেবে ধানের ভাগ নিয়ে যারা ধান কাটে তাদেরকে ‘ভাগালু’ ডাকেন গৃহস্থরা। অনেকের কাছে ধান কাটা শ্রমিকরা ‘বেফারি’ হিসেবেও পরিচিত। ধানভান্ডার হিসেবে খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকায় বৈশাখের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সদলবলে ধান কাটতে আসতেন ভাগালুরা। খাল-নদী হয়ে নৌকাযোগে দল বেঁধে আসতেন তাঁরা। গৃহস্থরা তাদের স্থান দিতেন বাংলোঘরে। আদর-আপ্যায়নে তাঁদের বরণ করতেন, বিদায় বেলায়ও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের বিদায় দিতেন।
যাবার সময় গৃহস্থরা তাদেরকে ধান কাটার ভাগ দিয়েও উপহার হিসেবে ‘খাসি’ ‘ষাঁড়’ দিতেন। সেটা সাজিয়ে নৌকায় করে ধানের সঙ্গে গান-বাদ্যের মাধ্যমে বাড়ি ফিরতের বেপারিরা। সেই দৃশ্য গত দেড়যুগ ধরে অনুপস্থিত সুনামগঞ্জের হাওরে। এখন প্রতি বছর শ্রমিকের অভাবে শ্রমঘামে ফলানো সোনার ধান পাহাড়ি ঢলে, শিলায় ও জলাবদ্ধতায় নিমিষেই তলিয়ে যায়। এবারও বেপারিরা না আসায় হাওরের কৃষকদের আধাপাকা ধান তলিয়ে গেছে। বোরো ফসলের মোট যে ক্ষতি হয়েছে তার অর্ধেক শ্রমিক সংকটের কারণে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ এপ্রিল দেখার হাওরের ৩০০ কোটি টাকার ফসলের মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ফসল ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। এর আগে শনির হাওরের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সময়মতো শ্রমিক পাওয়া গেলে এই দুই হাওরের ক্ষতি কিছুটা কমানো যেতো বলে তাঁরা মনে করেন।
হাওর এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নব্বই দশকের শেষ সময় পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বোরোধান কাটার মওসুমে শ্রমিকরা দল বেধে আসতেন। কুমিল্লা, ফরিদপুর, নরসিংদী, নোয়াখালি, জামালপুর, বরিশাল, বগুড়া, রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে চৈত্র মাসের শেষদিকে আসতেন তাঁরা। ধান কাটার ‘ভাগ’ নিয়ে গৃহস্থদের সাথে দরদাম করতেন। সঙ্গে নিয়ে আসতেন মাটির তৈজসপত্র এবং নানা ধরনের সবজি। বেপারি দল হাওরে ধান কাটতে বের হলে দলের ‘বাবুর্চি’ হাওরে খাবার দিয়ে এসে গ্রামে গ্রামে হেঁটে এসব বিক্রি করতেন ধানের বিনিময়ে। রাত হলে ফিরে ভাগালুরা আনন্দ আসরে মাততেন। দলের অনেকে বিভক্ত হয়ে ধান মাড়াই শেষ করে ভাগের ধান নিয়ে আসতো। এভাবে সকাল হলে আবার হাওরে ধান কাটতে ছুটতো ভাগালুর দল। তাদের উপস্থিতিতে হাওরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করতো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গানও এই অঞ্চলে গাইতেন তাঁরা। এতে সাংস্কৃতিক বিনিময়ও ঘটতো বলে গবেষকরা জানান। অনেক স্থানে ভাগালুদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কও তৈরি হতো।
হাওর গবেষকরা জানান, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নতির ফলে এখন দেশের বিভিন্ন স্থানেই উন্নয়ন অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অবহেলিত শ্রমিকদের ওই অঞ্চলেও গড়ে উঠেছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ফলে শ্রমিকরা এখন আর ধান কাটার মওসুমে হাওরে মৌসুমী শ্রম দিতে আসেন না। তাঁরা নিজ নিজ এলাকায়ই বিকল্প কর্মসংস্থান বেছে নেওয়ায় মৌসুমী এই শ্রমের সময় হাওরে আসার আগ্রহ ফুরিয়েছে। তাছাড়া হাওরাঞ্চলের নদ-নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা সংকুচিত হওয়ায় বেপারিরা না আসার অন্যতম কারণ বলে অনেকের মত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, প্রতি বছর পাহাড়ি ঢল ও শিলাবৃষ্টিতে হাওরের বোরো ফসলের যে ক্ষতি হয় তার বেশির ভাগই হয় শ্রমিক সংকটের কারণে। শ্রমিকরা না আসায় দিনদিন ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। চলতি মওসুমে বৈশাখের শুরুতেই আধাপাকা বোরো ধান পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিলায়ও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শ্রমিক থাকলে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগেও ক্ষতি কমিয়ে আনা যেতো বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে এ পর্যন্ত পাহাড়ি ঢলে, শিলাবৃষ্টিতে প্রায় ৫শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বেসরকারি হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ ১৫শ কোটি টাকার উপরে। সংশ্লিষ্টদের মতে ক্ষতির অর্ধেকটা হয়েছে কেবল শ্রমিক সংকটের কারণে। মওসুমের শুরুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের বিভিন্ন শাখা বিজ্ঞপ্তি প্রচার, মাইকিং করে কৃষকদের ধান কাটার পরামর্শ দিলেও শ্রমিকের কারণে আধাপাকা ধান গোলায় তোলতে পারেননি তাঁরা। সময়ে শ্রমিক পাওয়া গেলে কিছু ফসল রক্ষা করা সম্ভব হতো বলে কৃষকরা জানান।
তাহিরপুরের শনির হাওরপাড়ের কৃষক বাবরুল হাসান বলেন, দশ দিন আগে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে পুরো শনির হাওরের ৯৫ ভাগ তলিয়ে গেছে। উঁচু এলাকার জমি চোখের সামনে ধিরে ধিরে ডুবেছে। শ্রমিকের অভাবে উঁচু শ্রেণির সেই জমির ধানও কাটতে পারিনি আমরা। এভাবে বিদেশের ভাগালুরা না আসায় প্রতি বছর কৃষকের ক্ষতি বাড়ছে। তিনি হাওরের ধান কাটার উপযোগী মেশিন তৈরির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
দেখার হাওরপাড়ের কিষাণী নেকজান বিবি বলেন, ‘আগের দিন ভাগালুরা আইতো দলে দলে। দিনে ধান কাটতো, রাতে ঘুমাইবার আগ পর্যন্ত হান্ডি-পাতিল বাজিয়ে গান গাইতো। খুব ফূর্তি করতো তাঁরা। ধান কাটার আগে যখন তাঁরা আসতো তখনও তাঁদের বরণ করা হতো। যাবার সময় ভর্তি ধান দিয়ে সরদারের গলায় মালা পরিয়ে গৃহস্থরা তাঁদের বিদায় দিতো। এর আগে গৃহস্থের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে বিশেষ খাবার খাওয়ানো হতো। আমরা খুশি হয়ে তাঁদেরকে ভাগের চেয়েও কিছু বেশি ধান বিদায়ের সময় দিতাম। এখন আর কোন ভাগালু হাওরে আসেনা। আমরার ধান হিলে, পাইন্যে নেয়।
জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারিরা এসে হাওরে ধান কাটতো। আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসতো নানা উপকরণ। যাবার সময় নৌকা ভরে ধানের ভাগসহ গৃহস্থরা তাঁদেরকে উপহার হিসেবে খাসি, ষাঁড় দিতেন। আগামী বছর ফিরবেন এই ওয়াদা করে বিদায় নিতো তাঁরা। হাওরের নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়াসহ আর্থসামাজিক উন্নতির ফলে তাঁরা এই অঞ্চলে আসার আগ্রহ দেখান না। অনুন্নত এলাকা উন্নয়নের ফলে সেখানকার শ্রমিকরা এই অঞ্চলের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও কৃষি নির্ভর সম্ভাবনাময় এই এলাকার অবস্থা আরো নি¤েœর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভেঙে পড়ছে হাওরের কৃষি অর্থনীতি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, এক সময় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিকরা আসতেন। গত দেড় দশক ধরে তাঁরা আর আসছেন না বলে কৃষকরা আমাদের জানিয়েছেন। এখন প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগে শ্রমিকের অভাবে হাওরের ফসল নষ্ট হয়। এবারও ক্ষতির প্রায় অর্ধেক শ্রমিক সংকটের কারণে নষ্ট হয়েছে বলে তিনি জানান।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com