শামস শামীম ::
দেখতে দেখতে তলিয়েই গেল সুনামগঞ্জ জেলার বোরোভান্ডার খ্যাত দেখার হাওর। সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার এবং ছাতক উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত এই হাওরে এবার ২৪ হাজার ২১৪ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছিল। এ হাওর থেকে প্রায় ৩শ কোটি টাকার ফসল উৎপন্ন হওয়ার কথা ছিল। পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে, বাঁধ উপচে হাওরের প্রায় তিনভাগের দুইভাগ ফসল সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের মতে প্রায় ২’শ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ফসল হারিয়ে মাতম করছেন কৃষকরা। কৃষকরা চোখের সামনেই সর্বনাশা হাওরের রূপ দেখে মুষড়ে পড়েছেন।
কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, শনিবার ভোররাতে হাওরের টলাখালি বাঁধ, গুজাউনি বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকতে থাকে। একই সঙ্গে পাহাড়ি ঢলে মহাসিং নদীর দুই তীরের পানি উপচে হাওরে প্রবেশ করতে থাকে। দ্রুত ঢলের পানি বাড়তে থাকে। শনিবার বেলা ৪টার মধ্যেই ফসল নিয়ে তলিয়ে যায় হাওরটি। শনিবার বিকেলে হাওরের বুকে থৈথৈ জল লক্ষ্য করা গেছে। হাওরের বুকজুড়ে জল দেখে কেঁদেছেন চাষীরা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেখার হাওরকে সুনামগঞ্জের বোরোভান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আয়তনে ও উৎপাদনে জেলায় সর্বোত্তম এই হাওরটিতে এবার ২৪ হাজার ২১৪ হেক্টর জমি চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে শনিবার চারদিকে পানি ঢুকে সদ্য পাকা ধানগুলো তলিয়ে গেছে। কৃষি বিভাগ জানায়, সবেমাত্র কৃষকরা হাওরের জাঙ্গালে খলাঘর তৈরি করে ধানকাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ধান কাটা শুরু করতে না করতেই সোনার ফসল তলিয়ে যায়।
শনিবার বিকেল সাড়ে চারটায় দেখার হাওরপাড়ের গ্রাম গোবিন্দপুরের কৃষক সাইদুর রহমানকে দেখা গেল তলিয়ে যাওয়া ধানক্ষেতের আইলে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তার দৃষ্টি ধান তলিয়ে যাওয়া হাওরের দিকে। তার চোখের সামনেই সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে হাওরের ফসল ডুবে যাওয়া দেখে মুষড়ে পড়েছেন তিনি। জাঙ্গালে বসে হাওরের দিকে চেয়ে বিলাপ করছেন।
এই কৃষক জানান, এবার ৬০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি এক হাজার দুইশ শতক বোরোতে ধান লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৮ হাজার টাকা খরচ করে মাত্র ৩০০ শতক জমির ধান কেটে জাঙ্গালে রেখেছিলেন। শনিবার সকালে ৯০০ শতক জমির ধানসহ জাঙ্গালে কেটে রাখা ফসলও ডুবে গেছে।
সাইদুর রহমান বলেন, শুক্রবার বেফারিরে (শ্রমিকদের) ১০ হাজার টাকা আগাম দিয়া আইছলাম (আসছিলাম) আজুক (আজ) ধান খাটার লাগি। সকালে বেফারি লইয়া আইয়া দেখি আস্তা আওর (পুরো হাওর) দলা অইগিছে (শাদা হয়ে গেছে)। পাইড়া ঢল ইবার আমরারে জানে মাইরা গেছেগি (পাহাড়ি ঢল এবার আমাদের প্রাণে মেরে গেছে)। তিনি জানান, চোখের সামনে ধীরে ধীরে হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়া দেখেছে সর্বনাশা হাওর বুঝি এইবার সব কিছু গ্রাস করবে।
একই গ্রামের কৃষক আব্দুল্লাহ ১ হাজার ৮০ শতক জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে মাত্র ৩০০ শতক জমির ধান কাটতে পেরেছেন তিনি। চোখের সামনেই শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সোনার ফসল ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখে চোখে জল ফেলেছেন তিনি। এই কৃষক জানান, দেখার হাওরের সকল কৃষকের একই অবস্থা। শুক্রবার দিনেও হাওরটিতে সোনার ফসলের ঢেউ দেখা গেলেও শনিবার সেখানে ছিল জলের অগণন ঢেউ।
কৃষক আব্দুল্লাহ বলেন, কিতা খইমু বাবা বুকটা ফাইট্টা যারগি। চউকের সামনে দেখছি খেতের ধান পাইন্যে ভাসাইয়া নেরগি। খালি চাইয়া চাইয়া দেখছি। ঋণ কইরা ধান লাগাইছলাম। খোরাকিই উঠাইতে পারছিনা। সবতা নিছেগি। (কি বলব বাবা বুকটা ফেটে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখছি ক্ষেতের ধান পানি নিয়ে গেছে। শুধু চেয়ে দেখছি। ঋণ করে চাষ করেছিলাম। খাওয়ার ধানই কাটতে পারিনি। সব ফসল নিয়ে গেছে)।
একই গ্রামের কিষাণী নেকজান বিবিকে দেখা গেলো সড়কের পাশে একটি ‘লাঠিম’ গাছের তলায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে হাওরের দিকে চেয়ে আছেন। তিনি বলেন, ‘আউরের সর্বনাশা রূপ দেখছি বিয়ান থাকি হাইঞ্জা পর্যন্ত। হারাখারি (দ্রুত) আউরটি ডুইব্যা গেল। বিয়ান্তিবেলা যে জমিন খাড়া দেখছি হাইঞ্জাবেলা হেই জমিনে দেখলাম পানি আর পানি। আউরের এক মুইঠ ধানও আস্তা রাখছেনা। সবতা গিলিলাইছে।
সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নিগার সুলতানা কেয়া বলেন, শুক্রবার সকালে দেখার হাওরে সোনালী ফসলের ঢেউ দেখেছি। শনিবার সকালে এসে দেখে মনে হয়েছে এ যেন অথৈ সাগর। জেলার সবচেয়ে বড় এই হাওর তলিয়ে কৃষকের তিনভাগের দুইভাগ ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এই জনপ্রতিনিধি আরও বলেন, হাওরের ধান সবে পাকতে শুরু করেছিল। ঠিক এই সময়েই ডুবে গেল হাওরটি। হাওরের ফসল হারিয়ে কৃষক মাতম করছে বলে তিনি জানান। তিনি জানান, এ বছর এই হাওরের প্রায় ২শ কোটি টাকার ফসল তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, শনিবার দেখার হাওর তলিয়ে গেছে। এতে বেশ কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিপূরণ নিরূপণ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।