শহীদনূর আহমেদ ::
নাব্যতা সংকটে সুরমা নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। তাছাড়া দখল এবং দূষণ অব্যাহত থাকায় নদীটি কার্যত মরতে বসেছে। নদীর অনেক স্থানে চর জেগেছে। অনেক জায়গায় এমন অবস্থা হয়েছে যে, বোঝাই যায় না এক সময় সেখানে নদী ছিল। সেই নদীর বুকে এখন ধান রোপণ করছেন স্থানীয়রা। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় বন্ধ রয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল।
অভিজ্ঞমহল বলছেন, সুরমাকে ঘিরেই বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। সঙ্গত কারণেই নদীতে চর জাগায় হাওরের জীববৈচিত্র্যও সংকটে পড়ছে। সুরমাকে বাঁচাতে দ্রুত জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমা মেঘালয় থেকে এসে পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। সুরমার শাখা নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মরা সুরমা বা পুরাতন সুরমা, ধনু, বৌলাই, রক্তি, পান্ডার খাল, গোয়ারাইর খাল, মহাসিং, কালনী, মাছুখালী ইত্যাদি। পলি জমে ভরাট হতে হতে বদলে গেছে একসময়ের স্রোতস্বী সুরমা নদীর দৃশ্যপট। বর্ষায় কোনোমতে পান প্রবাহ বজায় থাকলেও হেমন্তে বিভিন্ন স্থানে নদীটি হয়ে পড়ে মৃতপ্রায়। যে কারণে সুরমার মূলধারা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ‘মরা সুরমা’ হিসেবে পরিচিত।
দিরাইর রাজানগর ইউনিয়নের গচিয়া থেকে নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর পর্যন্ত নদীর বিভিন্ন জায়গায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে সুরমা। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর গ্রাম থেকে দিরাই উপজেলার শরিফপুর পর্যন্ত ১০-১২ কিলোমিটার নদী পলিতে ভরাট রয়েছে। পলি জমে পুরাতন সুরমা নদী নাব্যতা হারিয়ে এখন মরণ দশায় পতিত হয়েছে। একসময় এই নদীগুলোর উত্তাল যৌবন ছিল, এখন নদীর অনেক অংশ শুকিয়ে গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে, নদী ভরাট ও সংকুচিত হওয়ার কারণে নদীকে কেন্দ্র করে আবহমান কালের হাওরাঞ্চলে গড়ে ওঠা নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এতে মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুতে গিয়ে হাওরের ওপর অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে। ফলে হাওরের পরিবেশ, প্রতিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের জামলাবাদ গ্রামের সমরাজ আলী (৭০) বলেন, আমি যখন যুবক ছিলাম শীত মৌসুমে তখন এই নদী দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতো। নদীতে বড়শী ও জাল দিয়ে বড় বড় মাছ শিকার করেছি আমরা। কিন্তু তিলে তিলে সুরমা নদী মরে যাচ্ছে, নাব্যতা সংকট দেখা দিচ্ছে। যার পরিণতি আমাদের জন্য ভালো হবে না।
ইউপি সদস্য মহিবুর রহমান বলেন, পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন, সুরমা নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। এখন নদীটি কেবল ক্ষীণ একটি ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদী এখন মূলত বিভিন্ন উপনদী থেকে পানি পাচ্ছে। উপনদীগুলোও দিন দিন অস্তিত্ব-সংকটে পড়ায় এ অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। অথচ সুরমাকে ঘিরেই সিলেটের হাওরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। সঙ্গত কারণেই নদীতে চর জাগায় হাওরের জীববৈচিত্র্যও সংকটে পড়ছে।
সেভ দ্য হ্যারিটেজ এর প্রতিষ্ঠাতা, গবেষক আব্দুল হাই আল হাদী জানান, দুটি কারণে সুরমা মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অপরটি শাখা নদী ও খাল বিলের রক্ষণাবেক্ষণ না করা। তিনি আরও বলেন, সুরমা দেশের প্রধান নদীগুলোর একটি। কিন্তু, শাখা নদীগুলো যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে তাতে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে পড়ছে সুরমা নদী। নদীটি পরিকল্পিতভাবে খননের মাধ্যমে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সমাজ অনুশীলন সিলেটের সদস্য সচিব মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা জানান, সুরমায় একসময় জাহাজ, বড় বড় স্টিমার চলতো। সেই নদীপথগুলোতে এখন বড় নৌকাও চলতে পারে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশে শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নদীর গতিপথ নষ্ট হচ্ছে, নাব্যতা হারাচ্ছে নদীগুলো। পলি পড়ার কারণে নদীগুলো প্রবাহ হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে প্রাক মৌসুমি বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং কৃষি ও জনবসতি ভাঙ্গনের সম্মুখিন হচ্ছে। নদীগুলোতে পরিকল্পিত ও ক্যাপিটেল ড্রেজিংয়ের দাবি জানিয়ে মুক্তা আরও বলেন, নির্দিষ্ট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে দুই একটি খাল খনন করলেই বন্যা সমস্যার সমাধান হবে না। নদীগুলোর গতিপথ অনুযায়ী নদী শাসন নিশ্চিত করে বাস্তবসম্মত প্রকল্প গ্রহণ জরুরি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, সুনামগঞ্জ জেলার অনেক নদীই অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জেলার সকল নদী খননের দাবি জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, মরা সুরমাসহ সুনামগঞ্জের ১৩ নদীর ৩০০ কিলোমিটার ড্রেজিং কাজের জন্য একটি প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। প্রকল্পগুলো অনুমোদন হলে নদীন খনন কাজ শুরু হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার জানান, শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে নাব্যতা সংকটের বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখছে।