২০২০ সাল নিয়ে সবার মাঝে একটা দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। টি-২০ ক্রিকেটের মত জোড়ায় মেলানো একটি সাল, ২০-২০। দেখতে ও বলতে ভালো লাগে, আর তাই এই ২০-২০ সালে অনেকেই অনেক পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, কোভিড-১৯ এসে জোড়া ২০-কে একেবারে কুপোকাত করে ফেলেছে। ফলে অনেকের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে, আনন্দে-আহ্লাদের পরিকল্পনা স্থগিত করতে হয়েছে। কিন্তু তাই বলে জীবন থেমে নেই। করোনার ধাক্কা সামলিয়ে নতুন-স্বাভাবিক জীবনে মানুষ দ্রুতই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বে যে দেশটি সবচেয়ে উন্নত, করোনার মহামারীর আশঙ্কার খবরে যে দেশের প্রেসিডেন্ট হেসেছিলেন, সেই আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়েই মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, তা আমাদেরকে জানিয়ে দিয়ে গেছে করোনা। আবার মনের জোর থাকলে, বুকে সাহস থাকলে এবং ভাগ্য সহায়ক হলে অনুন্নত ও ক্ষুদ্র একটি দেশও যে করোনার মত মহামারীর মোকাবেলায় সফল হতে পারে, তাও আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। তাই করোনা শুধু যে একটি মহামারী, তা নয়। বিশ্ববাসীর কাছে এ একটি উপদেশও বটে।
করোনার সবচেয়ে বড় উপদেশ- যোগ্যতমরাই বেঁচে থাকে (Survival the fittest)। হাজার হাজার বছর ধরে এ রীতিই চলে আসছে। বৃহদাকার ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারায় মানুষ যুগ-যুগান্তর ধরে টিকে আছে। তাই যারা যত দ্রুত নতুন স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হতে পারবেন, তারাই সফল হবেন।
করোনা একটি ভয়াবহ মহামারী এবং বিশ্বের অনেক মানুষের কর্ম হারানোর কারণ হলেও, কারো কারো জন্য তা আশীর্বাদ হয়েই এসেছে। ফলে বিশ্বের ধনীরা এই করোনাকালে আরও ধনী হয়েছে। বাংলাদেশেও কিছু লোকের কপাল খুলে দিয়েছে এই করোনা।
অন্যদিকে দেশ-বিদেশ জুড়ে শিক্ষার্থীদের জন্য করোনা অভিশাপ ও অশীর্বাদ- দু’রূপেই দেখা দিয়েছে। প্রথমতঃ করোনাকালে শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজে যেতে পারেনি, এখনো পারছে না। তাই শিক্ষা গ্রহণে তারা পিছিয়ে পড়ছে বলেই পণ্ডিতরা মনে করেন। দিতে পারছেনা পরীক্ষা, যাচাই হচ্ছেনা মেধা। কিন্তু পরীক্ষা দিতে না পারার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট বলে মনে হয় না। অবশ্য উচ্চ-শিক্ষার্থীদের তাড়া আছে, চাকুরি-বিয়ে সবই নির্ভর করছে পড়ালেখা শেষ করার উপর। তাদের ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক।
তবে এক বছর ঘরে বসে থাকার যে অভিজ্ঞতা, তা কিন্তু নেহাৎ কম নয়। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে লেখা-পড়া করার কৌশল শিখে ফেলেছে। মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মডেম, ইন্টারনেট, জুম, ডাউনলোড, ডেটা পাঠানো, গ্রহণ করা, বিভিন্ন ব্রাউজার, অ্যাপস ইতাদি তাদের কাছে এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। আর মা-বাবারাও ছেলে-মেয়েদের উপর থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারের বাধা উঠিয়ে নিয়েছেন, তবে আগের চেয়ে বেশি সতর্কও হয়েছেন। ফলে ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মন্দ কাজে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। এই যে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদেরকে ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতন করে তোলা- এ তো করোনারই ফল।
তাছাড়া ঘরে বসে থেকে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মা’র সাথে ইন্টারেক্ট করছে, বাসার কাজ করছে- তাদের মধ্যে মমত্ববোধ ও পারিবারিক শিক্ষা গভীর হচ্ছে- সেটাও বাড়তি পাওনা। অন্যদিকে অল্পসংখ্যক হলেও কিছু ছেলে-মেয়ে এই অবসরে প্রচুর বই পড়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা তো পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই খুব একটা পড়ে না, আবার বাবা-মাও পড়তে দেন না। করোনাকালে তাদের অপাঠ্য বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই শিক্ষার্থীদের কারো কারো সত্যিকারের মানুষ, আলোকিত মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতির জন্য এটি বড় প্রাপ্তি।
[লেখক মো. শাহাদত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ]