বাম রাজনীতির কিংবদন্তিতুল্য প্রবাদপুরুষ প্রসূন কান্তি রায়। কমরেড বরুণ রায় হিসেবেই তিনি পরিচিত। তিনি এক ইতিহাস – ঐতিহ্য – আদর্শ। তিনি সারা জীবন মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। সকল গণমুখী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন অকুতোভয়ে। জেল-জুলুম-নির্যাতনের পরোয়া করেননি তিনি। গণমানুষের শোষণমুক্তির আন্দোলন, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান ভাস্বর হয়ে আছে।
১৯২২ সালে ১০ই নভেম্বর তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা করুণাসিন্ধু রায়। তাঁর দাদা ছিলেন কৈলাশ রায়। কৈলাশ রায় বিহার সরকারের সচিব ছিলেন। থাকতেন পাটনায়। সেখানেই বরুণ রায়ের জন্ম। কৈলাশ ‘রায় সাহেব’ উপাধি পেয়েছিলেন। অবসর জীবন তিনি স্বগ্রাম বেহেলীতে কাটিয়েছেন। ১৯৫১ সালে করচার হাওরে এক নৌকা ডুবিতে মর্মান্তিকভাবে মারা যান। ১৯৩৭ সালে তার পিতা করুণাসিন্ধু রায় তদানিন্তন আসামের এমএলএ নির্বাচিত হন। কৃষকপ্রজা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন তাঁর পিতা করুণাসিন্ধু রায়। ‘কৃষকবন্ধু’ হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনার পর বরুণ রায় ছাতক এমই স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোগড়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে সেই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাস করেন। পরে সুনামগঞ্জ কলেজে ও সিলেট এমসি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি ১৪ বছর কারাগারে অতিবাহিত করেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, আয়ূব বিরোধী আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। জীবনের শেষ বয়সে তিনি ভাসান পানিতে মাছ ধরা আন্দোলন করে স্মরণীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি সারা জীবন গণমুখী আন্দোলনের সম্পৃক্ত থেকে এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।
বরুণ রায় ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আবার ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দুটি সংসদেই তিনি জনগণের দাবি দাওয়া নিয়ে সোচ্চার ছিলেন ও সংগ্রাম করেছেন। হাল আমলের রাজনীতিতে দেখা যায় সংসদে নির্বাচিত হলে অনেক সদস্যের রাতারাতি চেহারা-ছবির পরিবর্তন ঘটে ও বিত্তভৈবের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বরুণ রায়ের তো কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতার কাছে থেকেও ক্ষমতা তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি আদর্শ থেকে। তিনি তাঁর আদর্শে অটল থেকেছেন। তিনি যেমনটি ছিলেন তেমনটিই থাকলেন। সাধারণ মানুষের মতো জীবন-যাপন করেছেন। কোনো কালিমা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। নিষ্কলুষ হিসাবেই তিনি জীবন কাটিয়ে এক অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন।
এদিক দিয়ে বরুণ রায় এক আদর্শ পুরুষ। তাঁর জীবন থেকে সকলের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে। বিশেষ করে যারা রাজনীতি করেন তাঁদের তো বরুণ রায়ের জীবন থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন সর্বাধিক। বরুণ রায়ের জীবনের আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে ‘মানুষ মানুষের জন্য এবং জীবন জীবনের জন্য’ যেমন তাঁর আজীবনের স্বপ্ন সাধ ছিল। আদর্শবান রাজনীতিবিদ বরুণ রায় ২০০৮ সালের ৮ই ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে একটি জীবন্ত ইতিহাসের যবনিকাপাত হলো। তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবদানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের মনের মন্দিরে। বরুণ রায়ের মতো আদর্শবাদী ত্যাগী মানুষের মৃত্যু নেই। তিনি এক চিরঞ্জীব অনির্বাণ দীপশিখা।
[লেখক হোসেন তওফিক চৌধুরী : সিনিয়র আইনজীবী ও কলামিস্ট]