:: সুখেন্দু সেন ::
উনিশ’শো সত্তর। সুনামগঞ্জ কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের বাংলা কম্বাইন্ড ক্লাসের সাত নম্বর রুম, শ’তিনেক ছাত্রছাত্রীতে ঠাসা। “সূর্য দীঘল বাড়ী” উপন্যাসের করিমবক্স জয়গুনের একান্ত কথোপকথনের গোপন রহস্য উন্মোচনে বাংলা স্যারের সরস আলোচনায় নিস্তব্ধ হল রুম। এরই মাঝে ছন্দপতন।
মে আই কাম ইন স্যার।
উস্কু, খুস্কু চুল, শ্রান্ত, ঘর্মাক্ত মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে তালেব।
চোখ ফিরিয়ে চরম বিরক্ত স্যার-
সার্টের বোতাম লাগিয়ে এসো।
অপ্রস্তুত তালেব সলাজ হাসির রক্তিম মুখে মাথা নিচু করে বুকের বোতাম লাগাতে লাগাতে ক্লাসে ঢুকে।
হলজুড়ে অস্ফুট গুঞ্জন- জয় বাংলা।
জয়বাংলা অন্তপ্রাণ তালেবকে দেখলে প্রায়ই এমন উচ্চারণ সহপাঠীদের মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতো মনের অজান্তেই। সংগঠনের কাজে সদা ব্যস্ত তালেব মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে গানও গাইতো। গলায় সুর ছিলো না, গাইতো মনের আবেগে – ‘জয় বাংলা জয়ধ্বনি দিলে ইসলাম যায়গা চলে, এটা বলে কোন পাগলে…।’ বুঝতে পারা যায় স্বরচিত।
সুনামগঞ্জের ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ভিত্তি তখন খুব একটা ভালো নয়। দীর্ঘদিন থেকে বাম রাজনীতির প্রভাব এবং স্থানীয় বাম রাজনীতিকদের সক্রিয়তায় ছাত্র ইউনিয়নের দু’গ্রুপেরই প্রতিপত্তি।
জাগো জাগো বাঙ্গালি জাগো, তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা, ঢাকা না পিন্ডি – ঢাকা ঢাকা, আর মুক্তির অগ্নিমন্ত্র জয় বাংলা স্লোগান তুলে ছাত্রলীগের একটা ভিত্তি গড়ে তোলায় নিবেদিতপ্রাণ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক তালেব উদ্দিন আহমদ। সময়মত আসতে পারে না ক্লাসে, প্রায়ই লেট।
মুক্তির অবিনাশী আয়োজন যখন সমগ্র পূর্ববাংলা জুড়ে, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম যখন অনিবার্য তখন সে তালেব তো যুদ্ধে যাবেই। তবে গিয়েছিলো ট্রেনিং ছাড়া। মঙ্গলকাটা এলাকায় সামনাসামনি যুদ্ধে গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তালেব। আর সুনামগঞ্জ মুক্ত হলো সপ্তাহ খানেক পর। এ ক’দিন পিটিআই সেনা ক্যা¤েপ তাঁর উপর চলে একটানা অকথ্য নির্যাতন। জুবিলী স্কুলের মাঠে সভা ডেকেও করা হয় প্রকাশ্য অমানবিক নির্যাতন এবং অতি উৎসাহে দ্বিগুণ হিংস্রতা প্রদর্শন করে স্থানীয় দালালেরা। সদা হাসি মুখ তালেবের মুখমণ্ডল ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত, বিকৃত করে দেয় নরপশুরা। তবুও ‘জয়বাংলা’ মুখে একবারও ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ উচ্চারণ করানো যায়নি তালেবকে দিয়ে। ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে পিটিআই আস্তানা ছেড়ে পিছু হটে যাওয়ার পথে আহসানমারায় তালেবেকে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় পাকিস্তানী সেনারা। সঙ্গে আরও দু’জন সহযোদ্ধা। একজন কৃপেন্দ্র দাস, অন্য জন চ¤পক বাড়ৈ।
বোতাম খোলা বুক গুলিতে ঝাঁজরা হওয়ার কালেও হয়তো তালেবের মুখে উচ্চারিত হয়েছিলো তাঁর সেই প্রিয় উচ্চারণ- জ য় বাং লা। পরবর্তী সময়ে তিনজনকেই সমাহিত করা হয় জয়কলস হাই স্কুল প্রাঙ্গণে।