শামস শামীম ::
শাল্লা উপজেলার প্রত্যন্ত ও একসময়ে কথিত ‘চোরাপল্লী’ ছিকাডুবি গ্রামের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার মাঝি সঞ্জব আলী বলেন, ‘আমরা মুক্তির নাও চালাইয়া সংগ্রামের সময় কাজ করছি। আমরার মা ও বউরা মুক্তিরে রাইন্দ্যা খাবাইছে। ইতার লাগি আমরা মা বইনদের ধইরা নিছলো রেজাকার। আমরার গেরাম আগুনে পুড়াইয়া দিছল। দেশের লাগি অততা খরলাম অখনো আমরা কুনুস্তা পাইলাম না। আইজ ডিসি সাব আইয়া আমরারে খইছইন শেখের বেটির খাছ তনি ঘর আইন্যা দিবা। আমরা তাইনের কথায় খুব খুশি অইছি।’
এভাবেই একাত্তরে দুর্গম হাওরে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার মাঝি সঞ্জব আলী কথাগুলো বলে তার বঞ্চনা, ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানান। তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক তার গ্রামসহ দুর্গম গ্রামে গিয়ে তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন গ্রামবাসী।
‘মুজিব বর্ষে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না’ – ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আলোচনা সভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এই ঘোষণার পর সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দুর্গম হাওরের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন সন্ধান করছেন। দলিত সম্প্রদায়, বেদে সম্প্রদায়, একসময় চুরি পেশায় নিয়োজিত পশ্চাদপদ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে তাদের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত ওই তালিকাতে যাতে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষ স্থান পায় সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া গ্রামে গ্রামে গিয়ে যারা সরকারি ঘর পেয়েছেন সেই ঘরের নির্মাণকাজ যথাযথ হয়েছে কি না তাও প্রত্যক্ষ করছে প্রশাসন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের খোঁজ-খবর নেওয়ায় অসহায় পরিবারের মানুষজন জেলা প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। মুজিববর্ষে তারা ঘর ও ভূমি পাবেন এই স্বপ্ন দেখছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের গুচ্ছগ্রাম, জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পসহ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নানা প্রকল্প চলমান আছে। চলমান প্রকল্পে যাতে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা স্থান পান সেই লক্ষ্যে মাঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ। অসহায়দের জন্য সম্প্রদায় ভিত্তিক গুচ্ছগ্রাম তৈরির পরিকল্পনাও নিয়েছেন তিনি। যেখানে বেদে ও দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন স্থান পাবে। একই সঙ্গে হাওরাঞ্চলের দুর্গম কয়েকটি গ্রামের মানুষের একসময় চুরি ছিল পেশা। ’৯৬ সনের ভোটার তালিকায় পেশার ঘরে ‘চোর’ লিখে আলোচনার জন্ম দেওয়া দিরাই-শাল্লার উজানগাঁও, কামারগাঁও, নারকিলা, ছিকাডুবি, বল্লভপুর ও জাহানপুরেও ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। এ লক্ষ্যে সেপ্টেম্বর মাসে শাল্লা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নারকিলাতে ছুটে যান জেলা প্রশাসক।
শত বছর ধরে ওই গ্রামে শতাধিক পরিবার বসবাস করলেও এখনো তারা ভূমিহীন। রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে অবহেলায় রাখা হয়েছে বলে মনে করেন গ্রামবাসী। ওইদিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নারকিলা গ্রামের ভূমিহীন পরিবারগুলোর তালিকা করে দ্রুত জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার উদ্যোগের নির্দেশ দিলে দু’দিনের মধ্যেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি কর্মকর্তা গ্রামে গিয়ে ভূমিহীনদের তালিকা করে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য কথিত চোরাপল্লীর ওই গ্রামগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দুর্গম হাওরে মুুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা চালানো, রান্নাবান্না করে খাওয়ানো, অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনের কাজ করতেন তারা। এ কারণে ওই সবগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল রাজাকার বাহিনী। নারীদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। উজানগাঁও ও কামারগাঁওয়ে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে এমন সাহসী ভূমিকা থাকলেও এখনো ওই গ্রামগুলোর লোকজন ভূমিহীন ও গৃহহীনই রয়ে গেছেন। বরং ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সমর্থকরা ওই গ্রামগুলোও জ্বালিয়ে দিয়েছিল। চুরির অপবাদ দিয়ে এটা করা হলেও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার কারণেই এমন বর্বরতা চালানো হয়েছিল বলে মনে করেন গ্রামবাসী।
গত ১ অক্টোবর দিরাই উপজেলার শ্যামারচর এলাকায় ছুটে যান জেলা প্রশাসক। তিনি ওইদিন দলিত সম্প্রদায় ও বেদে সম্প্রদায়ের সঙ্গেও আলাদাভাবে বসে কথা বলেন। দলিত সম্প্রদায়য়ের জন্য গুচ্ছগ্রাম এবং বেদে সম্প্রদায়ের জন্য গুচ্ছগ্রাম করার পরিকল্পনার কথা জানান। সম্প্রদায়ভিত্তিক গুচ্ছ গ্রাম করে দিলে ভাসমান জীবন ছেড়ে গ্রামে থেকেই নিজেদের পেশা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। পরে তিনি দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সফি উল্লাহকে বেদে ও দলিত সম্প্রদায়ের তালিকা করার নির্দেশ দেন।
পরে শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের ছিকাডুবি ও ভল্লবপুর গ্রামে ছুটে যান জেলা প্রশাসক। এই গ্রামের সবাই একসময় বংশ পরম্পরায় চুরি পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। শত বছর ধরে গ্রামগুলোতে বসবাস করলেও তারা এখনো ভূমিহীন এবং খুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করেন। সামাজিক ঘৃণা ও রাজনৈতিক কারণে গ্রামগুলোকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে বলে সচেতন মহলের অভিযোগ। ওইদিন তিনি প্রতিটি খুপড়ি ঘরে গিয়ে গ্রামের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের সঙ্গে কথা বলেন। সরকার তাদেরকে ভূমি দিয়ে ঘর করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান। এসময় গ্রামের অবহেলিত নারী ও পুরুষেরা সজল নয়নে তাদের দুঃখের কথা জানান জেলা প্রশাসককে। জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিকভাবে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওই গ্রামগুলোর সবার তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন।
এদিকে শুধু ভূমিহীন ও গৃহহীনদের খোঁজাই নয় যারা ইতোমধ্যে সরকারি এই সুবিধা পেয়েছে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ ঘরগুলো যথাযথভাবে নির্মাণ হয়েছে কি না তা প্রত্যক্ষ করেছেন। ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত সংস্কার করে দেওয়ারও নির্দেশনা দেন তিনি। ওইদিন তিনি উজানগাঁও, বখতারপুরসহ কয়েকটি গ্রামে সুবিধাভোগীদের ঘরগুলোও দেখে আসেন।
শ্যামারচরের কমরেড অমরচাঁন দাস বলেন, জেলা প্রশাসকের এমন উদ্যোগের ফলে হাওর-ভাটির প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার আশার আলো দেখছে। বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের নজির সৃষ্টিকারী কথিত চোরেরগাঁওয়ের লোকজনের অবহেলিত গ্রামে গিয়ে তিনি তাদের মানবেতর অবস্থা প্রত্যক্ষ করে জমি ও ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শত বছর ধরে তারা বংশ পরম্পরায় বসবাস করলেও তারা এখনো ভূমিহীন ও গৃহহীনই রয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না। আমরা সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে মাঠে এসে সরেজমিন সুবিধাভোগীদের সঙ্গে কথা বলছি। মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রাখা একসময় নিষিদ্ধ পেশায় জড়িত গ্রামগুলোতে আমরা ভূমিহীনদের ভূমি ও ঘর করার পরিকল্পনা করছি। তাছাড়া সম্প্রদায়ভিত্তিক দলিত, বেদেসম্প্রদায়ের জন্য গুচ্ছগ্রামের চিন্তা-ভাবনা করছি। আমাদের কাছে পেয়ে গ্রামের অসহায় ও দরিদ্ররা তাদের অভাব, অভিযোগ ও বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন। আমরা উপজেলা প্রশাসনকে তাদের তালিকা করার নির্দেশনা দিয়েছি।