সেই আদিকাল থেকেই চলছে নারীর প্রতি চরম বৈষম্য। এই আধুনিক যুগেও এর চর্চা হচ্ছে চেতনে বা অচেতনে। যখন পুরো সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার চিন্তা ও চেতনায় মগ্ন। সাধারণত এই যুগে মুখে মুখোশ শব্দটি খুবই পরিচিত হচ্ছে নারীর প্রতি বৈষম্য। এখন অবশ্য এর ধরন পাল্টে গেছে এবং পাল্টে গেছে হয়রানির ধরন ও প্রকরণ। আধুনিকতা যে এক ধরনের মাদকতা তারও প্রমাণ এখন নারীর প্রতি বৈষম্যতা। এর প্রধান কারণও নারী। গণমাধ্যমে এখন প্রায়শই নারীর প্রতি সমাজের যে কুটচাল লক্ষ্য করা যায়, তা আদিম থেকেও আদিম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে শুধু ধরনটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। যদিও নারীদের প্রতি পুরুষদের যে বৈষম্য ও অনধিকার চর্চা তা খুব সহজেই রোধ করা যেত। কিন্তু প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে অনেক সময় অপরাধী সমাজকে স্বর্গরাজ্য ভেবে নেয়। যে রাজ্যে সে অপরাধ করেও নিরপরাধ জীবনযাপন করতে পারে। অধিকন্তু যে ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাকে হুমকি-ধমকি এমনকি বড় ছোট ধরনের ক্ষতিও করতে পারে। এভাবে যে সমাজের মানুষ পুরুষতান্ত্রিকতার চর্চা করে সে সমাজে দুই একজনের শাস্তি হয়তো নিশ্চিত করতে পারবে প্রশাসন তাও সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে কিন্তু ঘটনার পুনরাবৃত্তি রয়েই যাবে। তাছাড়া এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। নিত্য-নৈমিত্তিকভাবে এসব ঘটনা ঘটে আসছে। পার্থক্য হল দেশের প্রধান শহরের কিছু ঘটনা মিডিয়া কভারেজ পায় আর তারও পেছনে থাকে বড় কোনো মদদদাতা। নইলেও তাও পায় না, পেত না। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করলে বা লোক জানাজানি হলে মিডিয়া কভারেজ পায় কিন্তু প্রতি রাতে একাধিক পুরুষ দ্বারা ধর্ষিতা নারীর কান্না গোপনেই থেকে যায়। এসব জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই গ্রাম্য পরিবেশের খবর জানতে হবে।
একটা অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, পুরুষতান্ত্রিকতার আরও একটি ভয়ঙ্কর রূপ হলো পুরুষ কর্তৃক নারীদের ‘নিরাপত্তা দান’। একজন পুরুষই যখন একজন নারীর ধর্ষক তখন সেই পুরুষ দ্বারা নারী কতটা নিরাপদ থাকে বা থাকতে পারে। ভার্সিটি পড়াকালীন আমার এক বন্ধু বলেছিল, এখন আমাদের দূরত্ব মেনটেইন করা জরুরি। আরেক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল কেন? সে উত্তরে বলে, ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধুত্ব হয় নাকি। বিষয়টি আজো আমাকে ভাবায়। যদিও সেই বন্ধুটির সঙ্গে ২৮ বছর ধরে বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকে আছে।
এখন আরেক ফ্যাশন বেরিয়েছে দেশে। তা হলো নারীদের কারণে নারীরা ধর্ষণ, ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে তার প্রচারণা করা। এটা অবশ্য কিছু ইসলামিক বক্তাদের মুখ দিয়ে বেশি শোনা যায়। নিজেদের হিংস্রতাকে সামলাতে না পেরে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে নানাভাবে নারীকে দোষারোপ করাও একটা রীতি। মেয়েদের পোশাকের দিকে আঙ্গুল তোলা তারই দৃষ্টান্ত। স্পষ্ট করা উচিত যে, সমস্যাটা শুধু পুরুষের না, সমস্যাটা পুরো সমাজের। এদের সংখ্যা মোটেও কম নয়।
চর্যাপদ থেকে শুরু করে পুঁথিগান, কবিগান, বটতলার পুঁথি এমনকি আধুনিক সাহিত্যেও কখনো নারীকে ভোগের বস্তু, কখনো সর্বত্যাগী মহীয়সী নারী হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। তাই তো নারীর মুখ দিয়ে প্রকাশ করেছেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে বা তোমার জন্য এ সংসার ছাড়তে পারি।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শুরু থেকেই নারী হারিয়েছে তার মানবীয় সব গুণাবলি। এভাবেই পুরুষতন্ত্রের সব শ্রেণির প্রতিনিধিরা নারীকে যৌনবস্তুতে পরিণত করেছে। শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় বর্ণিত হয়েছে, নারী, সে নারী ভোগ্যপণ্য বিশেষ।
নারীদের নারী থাকার আরও একটা বিশেষ দোষ নারীদের মধ্যেই নিহিত থাকে। তা হলো এক নারী আরেক নারীর ঘোরতর শত্রু। এছাড়াও দেখা যায় যদি কোনো নারী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে তবে সেও খুব দ্রুতই উচ্চবিত্তের সাথে মিশে যায় এবং নিজের শ্রেণির নারীদের কথা বেমালুম ভুলে যায়। মোট কথা হলো, এটাই স্বাভাবিক বিষয় সামাজিক বস্তুগত পরিস্থিতিই এর আসল কারণ, এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আসল সমস্যা হলো, স্বাধীনতা বলতে নারীদের আজ যে মন ও মানসিকতা তৈরি হয়েছে তাতে তারা নিজেরাই একটি পণ্যে রূপান্তরিত হয়ে, প্রদর্শনী ও বিজ্ঞাপনের প্রধান উপাদানে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের গৃহে আটকে রেখে দাসীতে পরিণত করে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করতে চায় এবং অভিজাত শ্রেণি নারীদের তাদের ব্যবসার প্রসার ও মুনাফা লাভের হাতিয়ারে রূপান্তর করতে তৎপর। যদিও ভদ্রোচিতভাবে নারীদের সঙ্গে এই নির্মম আচরণ করা হচ্ছে, নারীরা তা মেনে নিয়ে পণ্যবিক্রির মাধ্যমে মুনাফা লাভ করে দিয়েও তাদের পরিত্রাণ মিলছে না। নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ চলমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎপাদন সম্পর্কের কারণেই তৈরি হয়েছে। এবং এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সীমাহীন অর্থলোভ ও লালসার। যদিও এ বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি ও আলোচনা ইতিমধ্যে হয়েছে। এবং সব আলোচনা ও লেখায় একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটে বা আগামীতেও তাই ঘটবে। কেননা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে বেগম রোকেয়ার পর আর কোনো নারীকেই নারীদের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়নি। তবে পরবর্তীতে যারা নারীদের পক্ষে আন্দোলন করছে তাদের অধিকাংশ কথা ও কাজের মধ্যে কোনো মিল রাখেনি বলে হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সমাজে। কিছুদিন আগেও সোশ্যাল মিডিয়ায় এক নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রীর কাজের মেয়ের প্রতি অস্বাভাবিক বাজে আচরণের চিত্র ভাইরাল হয়। এসব আন্দোলনের নেত্রী দিয়ে নারী সমাজ কতটা এগিয়ে যাবে আগামীর পথে, সে বিষয়টা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।
নারীর কর্মে ধর্মের কোনো বাধা নেই। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় কিছুটা গোড়ামী নারীদের মধ্যেও আঁচড় কেটেছে যুগের পর যুগ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে নারী এই আঁচড় থেকে বের হয়েছে সে হয়েছে পুরুষের ফটোকপি। যাই হোক, নারীরা গৃহবৃত্তিক নানা কাজ করবে, গৃহের কর্ম সম্পাদন, শিশুদের লালন-পালন ও বড় করে তোলাসহ নানাবিধ কাজ আদিমকাল থেকেই করে আসছে। এটাকে দোষের কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এগুলোর বাইরেও একটা বিশাল জগৎ আছে সেটা তাদের বুঝতে হবে, জানতে হবে, শিখতে হবে। সে জন্যও চাই সময়োপযোগী শিক্ষা। এবং সব নারীকে বাধ্যতামূলক শিক্ষার আওতায় আনতে হবে।