স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (শিক্ষা)’র গাড়ি চালক গ্রেফতার হওয়ার পর একজন বিখ্যাত গণমাধ্যমকর্মী বলেছেন, ‘সব লেবাসের আড়ালেই আমাদের চারপাশে বাস করে চোর, ডাকাত, লোভী, কদর্য, সব মানুষ। লুটেরা অর্থ পাচারকারী আর দুর্নীতির মোগলরা। মালেককে র্যাব ধরার আগে না মিডিয়া না মানুষ কেউ তার খবর জানল না!’ এবং অন্য একজন মন্তব্য করেছেন, ‘আবদুল মালিক চিকন পাতলা, এজন্য তাকে ধরা গেছে। […] মোটাতাজাদের কেউ ধরতে সাহস করছে না। বরং তাদেরকে বিদেশে চলে যেতে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।’ এমনটাই হয় এবং এমনটাই হবে, এটাই বাস্তবতা, এটাকেই বলে প্রপঞ্চ কিংবা ইংরেজি ‘ফেনমেনা’। এই বাস্তবতার ভেতরে কাজ করে চলেছে, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’ আইনের ক্যারিসমা-কেরদানি। লোকে ভাবছে, আইন দেখো না, তো আমারও দেখার কী দরকার নেই, নিজে বাঁচলে বাপের নাম।
কথা উঠেছে মালেকের খবর কেউ জানতো না। আসলে জানতো, তবে ‘চোর, ডাকাত, লোভী, কদর্য’ সব মানুষ কিংবা ‘লুটেরা অর্থ পাচারকারী আর দুর্নীতির মোগল’ হিসেবে নয়। সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই। সমাজটাকে এমনি করেই রাখা হয়েছে, সকল মানুষের কাছে প্রতিপন্ন করে দেওয়া হয়েছে এটাই স্বাভাবিক, মালেক হওয়াতে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই, নেই কোনও অনিয়ম। তেতালায় যে থাকে আর ফুটপাতে যে ঘুমায় দু’জনেই ভাবতে শেখানো হয়েছে এসব কীছুই ভাগ্যের ব্যাপার, নিয়তির কারসাজি। মালেক কিংবা মালেককে যারা মালেক বানিয়েছে তারা তো কেউ অন্য গ্রহের মানুষ নয়, এই জগতেরই স্বাভাবিক মানুষ। এটাই সমাজের নিয়ম, এটাই সামজিক প্রপঞ্চ কিংবা ফেনমেনা।
ঘটনাটির দুইটি দিক, মালেককে অপরাধী ভাবা এবং না ভাবা। গ্রেফতারের আগে পরের দুই মালেকের স্রষ্টাই এই সমাজ। এই সমাজটা এমন যে, সব লেবাসের আড়ালেই আমাদের চারপাশে বাস করি আমরা সকলে। অর্থাৎ লেবাসের আড়ালে আমরা যা তাই, নিজেকে কিংবা নিজের সঙ্গে ওতপ্রোত সত্যকে আড়াল করা। এখানে কেউই অপরাধী কিংবা নিরপরাধী নই। কিন্তু সকলের পক্ষ থেকে সকলকেই অপরাধী কিংবা নিরপরাধী ভাবা হচ্ছে। এই ভাবনায় এই সমাজের এই ধরণটার কোনও পরিবর্তন হয় না। মালেক ও মালেকদের স্রষ্টাদের সৃষ্টি হওয়ার কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায় না, সেটার চাকা ঘুরতেই থাকে। এই কারখানাটির নাম আর্থসামাজিক বিন্যাস ইংরেজিতে যাকে বলে সসিয়ো ইকোনোমিক্যাল ফরমেসন।
আসল কথা হলো আর্থসামাজিক বিন্যাসটাকে বদলে দিতে হবে। এটাকে বদলে দিতে হবে এভাবে যে, মালেক এবং মালেকের স্রষ্টাদের যাতে আর সৃষ্টি না হয়। যে-যতই চিল্লাফাল্লা করুন না কেন, এখন এই অবস্থায়, এটা তারা কেউ পারবেন না। যেমন পারছেন না মালেকের হোতাদের, অথবা মন্তব্যকরণেওয়ালার মতে ‘মোটাতাজাদের’ ধরতে। ইতিহাস জানে একজন বঙ্গবন্ধুকে চেষ্টাটি পর্যন্ত করতে দেওয়া হয় নি। তাঁর হত্যার বিচার পাওয়ার অধিকারটুকু পর্যন্ত হরণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পথই ধরতে হবে, তখন একদা ‘তারা কেউ পারবেন না’দেরকেই পারতে হবে। সুতরাং যা একদিন করতেই হবে তা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলাই সমীচীন। ভুলে গেলে চলবে না, পুঁজিবাদকে প্রত্যাহার না করলে মালেকদের কেচ্ছাকাহিনী চলতেই থাকবে। গণমাধ্যমে পুনরায় বলা হবে, ‘সব লেবাসের আড়ালেই …।’